প্রতিনিধি ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১ , ৪:১১:০২ প্রিন্ট সংস্করণ
পটের ছাপচিত্র। আসলে মাটির মায়ায় আঁকা কোনো ছবি এটি। শিল্পী এঁকে চলেছেন নিভৃতে। সবজির সবুজ চারায় গাঁথা এক-একটি পিলার। ঠিক মাঝখানটায় পেছন থেকে উঁকি দিচ্ছে লাল সূর্য। এ সূর্যও সপ্রাণ লাল সবজি দিয়ে পাতা। এর নিচের দিকেই বাংলা হরফে লেখা সেই চিরস্মরণীয় বাণী, ‘মোদের গরব মোদের আশা, আ’মরি বাংলা ভাষা’। আছে, ‘অ-আ-ক-খ’ও। আবার দুপাশে গাঢ় লাল-সবুজেই শোভা পাচ্ছে দৃষ্টিনন্দন সব ফুল।
মাটির জমিনে এভাবেই একুশের তাৎপর্যবহ সেই দিনের ছাপচিত্র এঁকে চলেছেন রুমান আলী শাহ নামে এক কৃষিখামার মালিক। বাড়ি তাঁর কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার গোবরীয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের জাফরাবাদ গ্রামে। বাজিতপুর থেকে আগরপুর বাসস্ট্যান্ড হয়ে সোজা পশ্চিমে যে সড়কটি ঢাকার দিকে চলে গেছে; এর ঠিক ডানদিকেই তাঁর খামার। লেখাপড়ার পাট না চুকিয়ে প্রবাসে পাড়ি জমানো স্বপ্নচারী মাঝবয়েসী এ মানুষটি দেশে ফিরেই খামারটি গড়ে তুলেছিলেন।
সেই খামারের একাংশেই তিনি নতুন প্রজন্মকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করার বাসনা থেকে মাটির ক্যানভাসে মহান সব শিল্পকর্মের চর্চা করে চলেছেন বছরব্যাপী। এর আগে তিনি একই জায়গায় সবজির চারায় আমাদের জাতীয় পতাকা এবং মানচিত্র এঁকে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। এবার একই জায়গায় আঁকলেন প্রাণের শহীদ মিনার। সামনের দিনগুলোতে চমকে দেওয়ার মতো আরো অনেক কিছুই করবেন বলে মনস্থির করে রেখেছেন তিনি।
সবজির শহীদ মিনারের পাদদেশে শেষ মুহূর্তের পরিচর্যা করছিলেন রুমান আলী শাহ।
আলাপকালে কালের কণ্ঠকে তিনি জানান নানা পরিকল্পনার কথা। জানালেন, ১৬ বছর আগেই তিনি দেশের টানে চলে আসেন। সঞ্চিত অর্থে এরপর ধীরে ধীরে গড়ে তোলেন এ খামারবাড়ি। প্রায় দেড় একর খামারের একটি অংশে শুধুমাত্র দেশের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশের জন্য বরাদ্দ করেছেন। জাতীয় দিবসগুলোতে এ ছয় শতাংশ ভূমিতে নানাভাবে বলে চলেছেন দেশমাতৃকার কথা।
তিনি বলেন, তরুণ প্রজন্ম ভাষা সংগ্রাম এবং মুক্তিযদ্ধের ইতিহাস কেবল বইতে পড়ছে। তারা জানে না, কেবলমাত্র ভাষার জন্য কতোটা ত্যাগ করেছে বীরজাতি বাঙালি। অকাতরে বিলিয়ে দিয়েছে জীবন। আজ সংগ্রামমুখর সেই একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে বিশ^ব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। এ যে কতোটা গর্বের! তাঁর ভাষায়, ‘সেই গর্বের মাহাত্ম্য এদের (নতুন প্রজন্মকে) ওইভাবে জানাতে সক্ষম হইনি আমরা। সেই বাসনা থেকেই আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস’।
রুমান আলী শাহ জানালেন, তিনি চান, তাঁর এ কাজ দেখে নতুনরা; বিশেষ করে শিশু ও শিক্ষার্থীরা সচেতন হোক। তাদের মনে আমাদের রক্তে অর্জিত মাতৃভাষা ও স্বাধীনতার দিনগুলো নিয়ে স্পৃহা জাগুক। দীক্ষিত হোক দেশেপ্রেমের অজেয় মন্ত্রে। দেশের জন্য প্রতিটি মানুষের মনেই তৈরি হোক অশেষ আগ্রহ ও শ্রদ্ধাবোধ। এভাবেই একদিন দেশ এগিয়ে বলেও মনে করেন তিনি।
জানা গেল, এ খবর জানতে পারলে প্রশাসনের কোনো কর্তাব্যক্তি একুশের দিনে এ শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে আসতেও পারেন। তবে রুমান আলী শাহের বেশি উৎসাহ সাধারণ মানুষেই। সরেজমিন দেখা গেল, আশেপাশের বিভিন্ন গ্রামের দশম শ্রেণীর ছাত্র তামীম বললো, মাটির বুকে সবজি দিয়ে শহীদ মিনার আঁকা সম্ভব বলে সে জীবনে কল্পনা করেনি। কিন্তু এখন বাস্তবেই সে এসব দেখতে পাচ্ছে! নবম শ্রেণীর ওয়াজেদেরও বিস্ময়ের ঘোর কাটছে না। তারা জানায়, এমন একটি কাজে হাত লাগাবার সুযোগ পেয়ে খুবই ভালো লাগছে।
রুমান আলী শাহ জানালেন, পয়লা ফেব্রুয়ারি থেকেই এ শহীদ মিনার নির্মাণের কাজটি শুরু করেছেন। আরো দুই-তিনদিন আগে শুরু করলে চারারা আরেকটু বড়ো হতো। তখন দেখতে আরো ভালো লাগতো।