প্রতিনিধি ১০ নভেম্বর ২০২১ , ৩:৪২:৫২ প্রিন্ট সংস্করণ
শিহাব আহম্মেদ-স্টাফ রিপোর্টার:
“শহীদ নূর হোসেন এখন শুধুই ইতিহাস” স্বৈরাচার নিপাত যাক, গণতন্ত্র মুক্তি পাক` স্লোগানটির সঙ্গে আমরা সবাই পরিচিত। এ স্লোগানটি যিনি বুকে ও পিঠে ধারণ করে তৎকালীন স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে (১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর) শহীদ হন তিনি নূর হোসেন। গণতন্ত্র ও শহীদ নূর হোসেন বাংলা মায়ের যমজ সন্তান। একই চেহারায় ভিন্ন দুটি নাম। গণতন্ত্র মানে নূর হোসেন, নূর হোসেন মানে গণতন্ত্র। সেই থেকে ১০ নভেম্বর শহীদ নূর হোসেন দিবস পালিত হয়ে আসছে। আর এ উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচি পালন করে।
শহীদ নূর হোসেনের পরিচিতি :নূর হোসেনের পুরো পরিচয় আমরা অনেকেই জানি না। তার পৈতৃক নিবাস পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের ঝাটিবুনিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মজিবুর রহমান ওরফে কাঞ্চন মিয়া এবং মায়ের নাম মরিয়ম বেগম। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়। নূর হোসেনের জন্ম ১৯৬৪ সালের কোনো এক বিকেলে ঢাকার নারিন্দায়।শহীদ নূর হোসেনের বংশের প্রাচীন পরিচিতি বিস্তারিত উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে তার বড় ভাই আলী হোসেনের সঙ্গে কথা বলে যত দূর জানা যায় তা হলো, ঝাটিবুনিয়া গ্রামে হাওলাদার বংশে বাবর আলী হাওলাদার নামে এক অভিজাত কৃষকের বসতি ছিল।
তার স্ত্রীর প্রথম ছেলের নাম কাদের হাওলাদার এবং দ্বিতীয় ছেলের নাম হাছেন আলী হাওলাদার। নূর হোসেনের পিতামহ হাছেন আলী হাওলাদারের ছিল পাঁচ ছেলে ও দুই মেয়ে।তার ছোট ছেলে কাঞ্চন হাওলাদার ছিলেন একটু অভিমানী স্বভাবের। বড় ভাই ও বাবা হাসেন আলী হাওলাদারের সঙ্গে অভিমান করে কাঞ্চন পা বাড়ান ঢাকার উদ্দেশে। কাঞ্চন হাওলাদার যেদিন ঢাকার সদরঘাটে পৌঁছেন সেদিন ছিল ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ। বিকেল গড়িয়ে তখন সাঁঝের বাতি জ্বালানোর প্রস্তুতি চলছে। ঘাটে নামতেই লোকজন তাকে জিজ্ঞেস করলো, কি ভাই কোথায় যাচ্ছ?
শহরের অবস্থা তো ভালো না।কাঞ্চন হাওলাদারের কথায়, সে সময়কার ঢাকার মানুষজনের মনে অনেক সহানুভূতি, দরদ আর মায়া-মমতা ছিল যেমনটি বর্তমানে খুঁজে পাওয়া দায়। কাঞ্চন হাওলাদার পরে পুরান ঢাকার নারিন্দায় বসবাস শুরু করেন। ঢাকা শহর জীবনের শুরুতেই তিনি পেয়েছিলেন তৎকালীন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হোস্টেলে মসলা গুঁড়া করার কাজ। পরে একই জায়গায় করেছেন সিক বয় ডিউটির কাজ। একই হোস্টেলে বেশ কিছুদিন বাবুর্চির কাজও করেন তিনি।তৎকালীন সংকটময় অবস্থার প্রত্যক্ষ সাক্ষী খেঁটে খাওয়া যুবক কাঞ্চন হাওলাদার বঙ্গবন্ধুর মহত্ত্বের কাছে মাথা নত করেন।
পুরোপুরি ভক্ত হয়ে পড়েন জাতির পিতার। যার ফলে বাবা-মায়ের দেয়া নাম কাঞ্চন হাওলাদার পরিবর্তন করে বঙ্গবন্ধুর নামের সঙ্গে মিল রেখে নিজের নামকরণ করেন মজিবুর রহমান। চিরচেনা গ্রাম, বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয় স্বজন সবার স্মৃতি পেছনে ঠেলে নতুন নামে নতুন শহরে দিনাতিপাত করতে লাগলেন তিনি।`১৯৫২ থেকে ’৫৪ সালের ঢাকার বুকে রাজনৈতিক ঘটনাবলির উত্থান-পতনকে যৌবনের বিস্ময় ভরা চোখে দেখেছেন মজিবুর রহমান। মুসলিম লীগ সরকারের সমস্ত অন্যায়, অত্যাচার আর নির্যাতন তাকে বিদ্রোহী করেছে। ৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের সময় নবাবপুর রোডে শের-ই-বাংলা ফজলুল হক, শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিরোধী দলীয় রাজনীতিতে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন।
আওয়ামী-লীগের প্রতি আস্থাশীল হয়েছেন।পল্টন ময়দানে একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে আলতাফ মাহমুদের কণ্ঠে ‘ও বাঙালি’ ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’ গানটি শুনে চোখের পানি ঝর ঝর করে পড়েছে তার। কেঁদে আকুল হয়েছেন মজিবুর রহমান। এ সময়ের পর থেকে মজিবুর রহমান জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের এবং আওয়ামী লীগের সব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন। এভাবে পুরো ষাটের দশকে তিনি রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় ছিলেন।মজিবুর রহমান বাবুর্চির কাজ থেকে ছাঁটাই হওয়ার পর ঢাকার অলিতে-গলিতে রিকশা চালিয়েছেন প্রায় আট বছর। ষাটের দশকের প্রথম দিকে তিনি বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন আশরাফ আলী শেখের মেয়ে মরিয়ম বিবির সঙ্গে।
মৃত আশরাফ আলী শেখের গ্রামের বাড়ি ছিল মুন্সিগঞ্জের রামপাল। ১৯৬২ সালের দিকে মজিবুর রহমানের প্রথম সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখেন। তার নাম রাখা হয় আলী হোসেন। দুই বছরের ব্যবধানে ১৯৬৪ সালে দ্বিতীয় সন্তান নূর হোসেনের জন্ম হয়। ১৯৭০ সালের দিকে তখন মজিবুর রহমান পরিবার নিয়ে গেন্ডারিয়ায় এক বাসায় ওঠেন।১৯৭১ সাল। রাজনৈতিকভাবে দেশের নানা উত্থান-পতন দেখতে দেখতে খাঁটি দেশপ্রেমিক বনে যান নূর হোসেনের দরিদ্র বাবা মজিবুর রহমান। ৭ মার্চ মজিবুর রহমান ব্যক্তিগতভাবে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ প্রত্যক্ষভাবে উপস্থিত থেকে না শুনতে পারার কারণে। কারণ সেদিন তিনি হাসপাতাল থেকে বেবিট্যাক্সিতে করে একজনের মরদেহ গাজীপুরের বর্মি বাজারে নিয়ে যান।
ফিরতে ফিরতে রাত ৯টা বেজে গিয়েছিল। দেশের অবস্থা ক্রমে খারাপ হতে থাকে। কারফিউ জারি করা হয় সারা দেশে। জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। ২৭ মার্চ কারফিউ প্রত্যাহার করা হলে পরিবার নিয়ে মুন্সিগঞ্জের রামপালে পাড়ি জমান মজিবুর রহমান। দুই ছেলে আলী হোসেন আর নূর হোসেনের সুন্নাতে খাৎনা করানো হয়েছিল সে মাসেই। দেশের এ রকম বর্বর অবস্থায় খত নিয়েই ঢাকা শহর ছাড়তে হয়েছিল তাদের। কিছুদিন রামপালে থাকার পর পেটের তাড়নায় বাচ্চাদের মুখের দিকে চেয়ে আবার ঢাকায় আসতে হয় মুজিবুর রহমানকে।নূর হোসেনের শৈশব, কৈশোর ও যৌবন :নূর হোসেনের শৈশব শুরু হয় ঢাকার নারিন্দায়।
তারপর কিছুদিন থাকেন ৭৮/১ বনগ্রামে ও গেন্ডারিয়ায়। আবার বেশ কিছুদিন থাকেন মুন্সিগঞ্জের রামপালে। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের দুই বছর পর তার পরিবার স্থান পরিবর্তন করে ঢাকার ৭৯/১ বনগ্রাম রোডে আসার সুবাদে তার পরবর্তী জীবন অতিবাহিত হয় বনগ্রামেই। ছোটবেলা থেকেই নূর হোসেন ছিলেন খুবই চঞ্চল প্রকৃতির। বয়স বাড়তে বাড়তে হয়ে ওঠেন এক চঞ্চলমতি কিশোর। দিন কাটতো তার ঘোরাফেরা করে।বনগ্রামের এ-বাড়ি ও-বাড়ি সবখানেই ছিল তার অবাধ যাতায়াত। তিনি এতই মিশুক ছিলেন যখন যে বাড়িতে ইচ্ছে সে বাড়িতেই খেতে বসে পড়তেন। ভালোবাসতেন সবাইকে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম হলেও নিজেকে মানিয়ে নিতেন যেকোনো পরিবেশে।
ধন্যবাদান্তে-
সাজ্জাদুল হক লিকু সিকদার
সহ-সভাপতি
বাংলাদেশ আওয়ামী মৎস্যজীবী লীগ