মোঃ লুৎফর রহমান লিটন-সলঙ্গা সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি:
বাংলার সাহিত্য অঙ্গণে স্বীয় জ্ঞান, দক্ষতা ও মেধার সমন্বয়ে মননশীল সাহিত্য রচনার মাধ্যমে যে মানুষটি লক্ষ লক্ষ সাহিত্যানুরাগী বাঙালির হৃদয়রাজ্যে স্থায়ী আসন করে নিয়ে ছিলেন তিনি আর কেউ নন,তিনি হলেন বাংলা মুসলিম পূণর্জাগরণের ভোরের মুয়াজ্জিন, অমর কথা শিল্পী মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যররত্ন।
নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের জন্ম সাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও অধিকাংশের মতে তিনি ১৮৬০ সালেের ২২ জানুয়ারি তৎকালীন বৃহত্তর পাবনা জেলার বর্তমান সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের চরবেলতৈল গ্রামে এক সম্ভান্ত্র মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন।তাঁর পিতা ছিলেন জয়েনউদ্দিন সরকার ও মাতা সোনাভান বিবি।তবে তাঁর পিতা-মাতার নাম নিয়েও গবেষকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে।কেউ কেউ মনে করেন৷ নজিবর রহমানের পিতার নাম ছিল আবেদ উদ্দিন বা জোনাব আলী৷ সরকার।মাতার নাম হালিমুন্নেছা মতান্তরে সোনাভানু।
মোহাম্মদ নজিবর রহমানের সময়ে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা খুবই কম ছিল।জানা গেছে ঐ সময়ে কোনো কোনো গ্রামে শিক্ষিত মানুষই ছিল না।সেই পারিপার্শ্বিকতার মধ্যেও তিনি গ্রামের পাঠশালা শেষ করে শাহজাদপুর মধ্য বাংলা স্কুলে লেখা পড়া করেন।পাঠশালা পড়ার সময়ই তিনি তাঁর পিতার কাছ থেকে কোরআন পড়া শেখেন।তারপর ঢাকার একটি স্কুল থেকে নর্মাল ( বর্তমানে এস.এস.সি) পাশ করেন।তিনি তুখোড় মেধাবী ছাত্র ছিলেন।অনেক গ্রাম থেকে তাঁকে দেখার জন্য মানুষ তাঁর বাড়িতে ভীর করেন।এ সময় কালে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর দরিদ্রতার কারণে তিনি আর লেখাপড়ায় অগ্রসর হতে পারেননি বলে জানা য়ায়।।ফলে তিনি জড়িয়ে পড়েন পেশাগত জীবনে।
কর্ম জীবনে মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন মানুষ কে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য বেছে নিয়ে ছিলেন শিক্ষকতার মত মহান পেশা।তিনি প্রথমেই নিজ গ্রামের পাঠশালায় মাসিক সাত টাকা বেতনে চাকরি নেন।১৮৯২ সালের দিকে তিনি নিজ গ্রামে একটি মক্তব প্রতিষ্ঠা করেন।যা পরবর্তীতে বালিকা বিদ্যালয় রুপান্তরিত হয়।তিনি সিরাজগঞ্জের ভাঙ্গাবাড়ি মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেন।উনিশ শতকের প্রথমার্ধের দিকে তিনি নিজ উদ্দীপনায় ফুলজোড় নদীর পূর্ব পাড়ে নুন-নগর গ্রামে একটি নর্মাল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন।কিন্তু কয়েক বছর পরে অজ্ঞাত কারণে স্কুলটি উঠে যায়।প্রতিষ্ঠানটি ভেঙে গেলেও তাঁর মনোবল ভেঙ্গে যায়নি।তিনি নব উদ্যমে সলঙ্গায় আর একটি মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষকতা পেশা চালিয়ে যান। নানা প্রতিকুলতার কারণে তিনি তাঁর প্রতিষ্ঠিত সলঙ্গা মাইনর স্কুল থেকে চাকরি ইস্তফা দেন। তাঁর স্মৃতি-বিজড়িত সলঙ্গার মাইনর স্কুলটি সলঙ্গা ইসলামিয়া উচ্চ বিদ্যালয় নামে আজও কালের সাক্ষী হয়ে এ অঞ্চলের মানুষের মাঝে দ্যূতি ছড়িয়ে যাচ্ছে।তিনি হাটিকুমরুলে আরেকটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে সেখানেই মৃত্যুর আগ পর্যন্ত শিক্ষকতা করেন।এছাড়া তিনি রংপুর নর্মাল স্কুল ও রাজশাহী জুনিয়র মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন।তিনি কিছু দিন ডাক বিভাগে পোস্ট মাস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্নের সংসার জীবন তেমন সমৃদ্ধ ছিল না।বার বার পত্নী বিয়োগের কারণে তাঁর জীবন, জীবিকা ও সংসার বাঁধাগ্রস্থ হয়েছে। তবে তিনি বৈরাগ্য জীবন যাপন করেননি।তাঁর প্রথম স্ত্রী সাবান বিবি বিয়ের অল্প কিছু দিন পর নিঃসন্তান অবস্থায় মৃত্যু বরণ করেন।তারপর তিনি আলিমুন্নেছার সাথে দ্বিতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।স্ত্রীআলিমুন্নেছার গর্ভে আমিনা খাতুন ও গোলাম বতু নামে দুইটি সন্তান জন্ম গ্রহণ করে।দ্বিতীয় স্ত্রী আলিমুন্নেছার সাথে তাঁর সুখময় সংসার বেশি দিন স্থায়ী হয়নি।কয়েক বছর পরেই আলিমুন্নেছা মহান প্রভুর ডাকে সারা দিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে।স্ত্রী বিয়োগান্তে সন্তান দুটি নিয়ে বিপাকে পরে যান মোহাম্মদ নজিবর রহমান। সন্তানদের কথা চিন্তা করে তিনি তোয়াজান বিবির সাথে তৃতীয় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তোয়াজান বিবির গর্ভে জন্ম নেন মীর হায়দার আলী,জাহানারা খাতুন ও রওশনারা খাতুন।কিন্তু তোয়াজান বিবি সতিনের সন্তানদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করার পাশাপাশি নিজের সন্তানদের সঙ্গেও নোংরা ব্যবহার করতে থাকেন বলে জানা যায়।এতে মোহাম্মদ নজিবর রহমান আত্মীয় স্বজনের কাছে লজ্জিত হন।তিনি তোয়াজান বিবি কে বুঝিয়েও কাজ হয় না।তখন তিনি সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য রাহিমা খাতুন নামে শিক্ষিত এক মেয়ের সঙ্গে চতুর্থ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।রহিমা খাতুনের গর্ভে মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান ও মমতাজ মহল নামে দুইটি সন্তানের জন্ম হয়।মোহাম্মদ নজিবর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর ছেলে গোলাম বতু রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯২২ সালে বিএ পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি এসে অসুস্থ হয়ে মৃত্যু বরণ করেন।তার মৃত্যুর পর পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায় তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে প্রথম বিভাগে বি এ পাশ করেছেন।এতে মোহাম্মদ নজিবর রহমান মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন।
মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন ছিলেন ইসলামী মুল্যবোধ ও চিন্তাধারার মানুষ। ১৯০৬ সালে স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্ব ঢাকায় মুসলিম লীগ গঠনের সময় তিনি এ অঞ্চলের নিপিড়ীত, নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত মুসলমানদের প্রতিনিধি হিসেবে সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। তিনি সলঙ্গা মাইনর স্কুলে শিক্ষকতা কালীল সময়ে সলঙ্গা অঞ্চলে স্থানীয় হিন্দু জমিদার কর্তৃক গো জবাই নিষিদ্ধ ছিল। তিনি এ অঞ্চলের মুসলমানদের নিয়ে প্রতিবাদ করে অন্যায় নিষেধাজ্ঞা প্রতিহত করেন।কিন্তু তিনি জমিদারের নায়েব কর্তৃক সাম্প্রদায়িক রঙে রঙ্গিন হয়ে দুঃখ- ভারক্রান্ত মন নিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠিত স্কুল ছেড়ে ধুবিলের জমিদারের সহযোগিতায় হাটিকুমরুলে স্থায়ী বসতি ও মাইনর স্কুল গড়ে তুলেছিলেন।
মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন বাংলার গ্রামীণ মধ্যবিত্ত মুসলমান সমাজের পারিবারিক, সমাজিক রীতিনীতি, ধর্ম ও সত্যের জয় এবং অধর্মের পরাজয় অতি সুন্দর ভাবে তাঁর " আনোয়ারা "ঔপন্যাসে চিত্রায়িত করেছেন।তিনি ছিলেন মুসলিম সমাজের প্রতিনিধি।ধর্মকে আশ্রয় করে সাহিত্য চর্চা করলেও তিনি ছিলেন মানবিক গুণে আধুনিক।উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝিতে ধুমকেতুর মত মোহাম্মদ নজিবর
E-mil: dailyalokito71sangbad@gmail.com
তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদনকৃত গণমাধ্যম দৈনিক আলোকিত ৭১ সংবাদ
@বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোক চিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বে-আইনি।
Copyright © 2024 alokito71sangbad. All rights reserved.