• আমার দেশ

    রোহিঙ্গা প্রশ্নে পরাশক্তি কতদিন নীরব থাকবে?

      প্রতিনিধি ৯ মার্চ ২০২২ , ১২:৫৯:২৮ প্রিন্ট সংস্করণ

    মিয়ানমারের সামরিক জান্তার আরাকান তথা রাখাইন প্রদেশে রোহিঙ্গা গণহত্যার বর্বরতা যখন তুঙ্গে, তখন সাগরপথে দক্ষিণ চট্টগ্রাম সাগর প্রান্তে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ঢল নেমেছিল ঢেউয়ের মতো সময়ান্তরে। বাংলাদেশ তখন বিবেচনায় তাদের আশ্রয় দিয়েছিল কক্সবাজার পর্যন্ত বহুসংখ্যক শরণার্থী শিবিরে। রাজনৈতিক স্বার্থ-বিবেচনা তখন বড় বিষয় ছিল না। যুক্তরাষ্ট্র তখন বিষয়টিকে উসকে দিয়েছিল, এগিয়ে দিয়েছিল তাদের বসম্বদ জাতিসংঘ নামক নখদন্তহীন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে। জাতিসংঘ এ পর্যন্ত কোনো মানবিক বিপর্যয়ে কোনো জাতি বা রাষ্ট্রকে যুক্তিসঙ্গত পথে মুক্ত করতে পেরেছে, এমন উদাহরণ প্রায় বিরল। বরং তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থরক্ষার কাজটিই সার্থকভাবে সম্পন্ন করার চেষ্টা চালিয়েছে।

    এসব বিবেচনায় সে সময় চীন-মার্কিনি বিশ্ব রাজনীতি-কূটনীতির শিকার হয়ে বাংলাদেশের দক্ষিণ চট্টগ্রাম রোহিঙ্গাস্থান হওয়ার আশঙ্কা প্রকাশ করে সতর্ক বার্তা উচ্চারণে একাধিক প্রবন্ধ লিখি, কেউ তাতে কান দিয়েছিলেন বলে মনে হয় না। শরণার্থী যে অবস্থাগুণে স্থায়ী বাসিন্দা হতে পারে, চোখের সামনে পাকিস্তানি দৃষ্টান্ত থাকা সত্ত্বেও এ সম্পর্কে সচেতন গুরুত্বারোপ করা হয়েছে বলে মনে হয় না। এখন দিনকে দিন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সমস্যা প্রথমত মিয়ানমারের সামরিক জান্তার চতুর রাজনীতি এবং বিশ্ব পরাশক্তির উদাসীনতার কারণে স্থায়ী রূপ নিয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ও গ্রাহ্য করছে না মিয়ানমার। শান্তি ও গণতন্ত্রের নোবেল পুরস্কার জয়ী অং সান সুচির ভূমিকাও এ বিষয়ে রীতিমতো আপত্তিকর, গণতন্ত্রবিরোধী; ন্যক্কারজনক বলাই বোধ হয় সঙ্গত।

    দুই.
    ইতোমধ্যে নাফ নদে অনেক পানি বয়ে গেছে, তবু মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সহিংস ও অমানবিক ভূমিকার পরিবর্তন ঘটেনি। পরিবর্তন ঘটেনি সুচি চরিত্রের। হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে তার সাক্ষ্য ও গণতন্ত্রবিরোধী ভূমিকায় অনেক সূত্র ধিক্কার জানিয়েছে, অনেক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুচির নোবেল পুরস্কার প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছে নোবেল কমিটির উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে প্রত্যাবাসন বিষয়ে নীরব চীন, যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি রাশিয়া বা আমাদের কথিত মিত্র দেশ ভারত। কী বিস্ময়কর আন্তর্জাতিক রাজনীতি-কূটনীতি! বাংলাদেশকে কেবল আশ্বাসের ওপর নির্ভর করে সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে। আর জাতিসংঘ রোহিঙ্গা শিবিরে ত্রাণ সরবরাহ করেই তাদের দায়িত্ব পালন করছে। বারবার মিয়ানমার জান্তার মুখোমুখি হয়েও তাদের নেতিবাচক আচরণের বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না।

    কারণ হয়তো একটাই। প্রভু এবং অন্যরা নীরব। তাই বারবার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ক বাংলাদেশের প্রস্তাব কঠিন পাথরে ধাক্কা খেয়ে ফিরে আসছে। চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতির সঙ্গে এ বিষয়ে বাংলাদেশি কূটনীতির বরফগলার কোনো লক্ষণই এত বছরেও প্রকাশ পাচ্ছে না। চীনা কূটনীতির চাতুর্যের কাছে বাংলাদেশি কূটনীতি ব্যর্থ প্রমাণিত হতে চলেছে। ভারতসহ অন্যদের তরফ থেকে কার্যকর হতে পারে, এমন কোনো সমর্থন পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্ভাগ্য বাংলাদেশের যে, রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রশ্নে মানবিক ভূমিকা রাখতে গিয়ে তার দিশাহারা অবস্থা। এ পরিস্থিতির কবে পরিবর্তন ঘটবে, কেউ বলতে পারবে না।

    তিন.
    ইতোমধ্যে রোহিঙ্গা শিবিরগুলো কেন্দ্র করে রোহিঙ্গা সমাজে, এমনকি আরাকানি বিদ্রোহীদের মধ্যে অনেক পানি ঘোলা হওয়ার দুটি লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে। রোহিঙ্গারা কালক্ষেপণের ধারায় একাধিক চিন্তায় বিভাজিত। প্রত্যাবাসনমুখীরা সহিংসতার শিকার, অন্তত একটি হত্যাকাণ্ড তার প্রমাণ। রোহিঙ্গা তরুণ ও যুবাদের একাংশ মাদক সন্ত্রাসীপনা ও জঙ্গিবাদে আকর্ষিত, অন্য অংশ আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতিভিত্তিক ষড়যন্ত্রের শিকার। তারা বাংলাদেশ ভূমি ছাড়তে নারাজ। দৃশ্যত নিরাপত্তার কারণে, বাস্তবে আন্তর্জাতিক কূটনীতির প্রভাবে।

    অন্যদিকে বিদ্রোহী আরাকানি গ্রুপ তাদের কর্মক্ষেত্র আরাকানে সীমাবদ্ধ রাখছে না, তারা জড়িয়ে পড়ছে শরণার্থী শিবিরগুলোর রাজনীতির সঙ্গে, মূলত সহিংসতায়। আমাদের দৈনিক পত্রিকা উল্লিখিত বিষয়ের খবরে ভর্তি। যেমন একটি শিরোনাম : ‘জান্তা সেনার বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ আরাকান আর্মির’ (কালের কণ্ঠ, ৮.২.২০২২)। মিয়ানমারও শান্তিতে নেই, ছিল না সাম্রাজ্যবাদীদের ভূমিকার কারণে। ষড়যন্ত্র, অন্তর্দ্বন্দ্ব, রক্তপাত, হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা সেই উপমহাদেশ বিভাগ ও ক্ষমতার হস্তান্তরের কাল থেকে। সেই সময়ের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সুচির পিতা অং সান হত্যা অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব।

    তখন থেকে এখন পর্যন্ত, বহু জাতি সমন্বিত মিয়ানমারে জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে শাসক জান্তার লড়াই চলছে অনেক বিদ্রোহী জাতিসত্তার। অশান্ত সামরিক শাসিত মিয়ানমার।একদিকে দমননীতি, গণহত্যা, অন্যদিকে ভিন্ন ভিন্ন বিদ্রোহী গ্রুপের আক্রমণে নৈরাজ্য দেখা দিচ্ছে মিয়ানমারে। যেমন একটি সংবাদ শিরোনাম : ‘জান্তার সেনাদের ভাগিয়ে আনছে আন্দোলনকর্মীরা’। ভাবা যায় এমন অবিশ্বাস্য ঘটনার কথা, তাও মিয়ানমারে আধাসামরিক শাসনামলে? কিন্তু এসব ঘটছে।

    এখানেই শেষ নয়। ঘরে বাইরে এতসব অঘটন সত্ত্বেও মিয়ানমার জান্তা ও তাদের জওয়ানরা তাদের বর্বরতার সুনাম (?) রক্ষা করে চলেছে। সম্ভবত বিদ্রোহীর সহযোগী সন্দেহে ‘প্রত্যন্ত গ্রামে কয়েকশ বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে সেনারা’ (কালের কণ্ঠ, ৬.২.২০২২)। এটা তাদের বিরুদ্ধে নানামাত্রিক অভ্যুত্থান ঠেকানোর চিরাচরিত কৌশল। এটা মঙ্গোলীয় নিষ্ঠুরতার একটি উদাহরণ বলে যুক্তি টানতে পারছি না এ কারণে যে, একাত্তরে (১৯৭১) পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি সেনাদের অনুরূপ আচরণের অনেক ঘটনা আমাদের জানা। কাজেই পীত (মঙ্গোলীয়) রেসের নিষ্ঠুরতা একচেটিয়া নয়, নয় মগ ও মিয়ানমার জলদস্যুদের বর্বরতার একক দৃষ্টান্ত নয়। যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ কে-কে-কে কিংবা পূর্ব-দক্ষিণবঙ্গে শ্বেতাঙ্গ পর্তুগিজ জলদস্যুরা একই রকম বর্বরতার ইতিহাস তৈরি করেছে।

    বৈচিত্র্য সব দেশেরই বৈশিষ্ট্য। তাই বর্মি সেগুন আর শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের বর্মি সমাজ, বিশেষত নারীদের ভিন্ন চরিত্র একদা আমাদের মুগ্ধ করেছে। কিন্তু সুচি কি সেইসব নারী চরিত্রের প্রতিনিধিত্ব করে? একেবারেই না। ক্ষমতার মোহে অন্ধ সুচি সম্ভবত তার পিতার রাজনৈতিক মতাদর্শেরও প্রতিনিধিত্ব করে না। মিটফোর্ডে আমার সঙ্গে যে ক’জন তরুণ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বিদ্রোহীর পরিচয় হয়েছিল, তাদেরও চরিত্র-চিত্র ছিল ভিন্ন, সম্ভবত নিপীড়িত জাতিসত্তার সদস্য বলে। ‘মানুষ’- এই শব্দটিই এসব ক্ষেত্রে প্রধান দেশ রেসবর্ণ জাতি নির্বিশেষে। এটাই কাম্য। কিন্তু মিয়ানমারের শাসকদের মধ্যে সেই ‘মানুষ’ নামের মানবিক সত্তাকে খুঁজে পাচ্ছি না, এটাই বাংলাদেশের জন্য মিয়ানমার-বিষয়ক বড় সমস্যা।

    আহমদ রফিক-
    লেখক, গবেষক ও ভাষা সংগ্রামী।

    আরও খবর

                       

    জনপ্রিয় সংবাদ