রবিউল আউয়াল ( ربيع الأول) ইসলামিক বর্ষপঞ্জির তৃতীয় মাস।১লা রবিউল আওয়াল তারিখের রাতটি ইসলামের ইতিহাসে “লাইলাতুল মাবিত” নামে সুপরিচিত। নবীজি জন্মগ্রহণের কারণে যেমন এই মাসের ফজিলত বেড়েছে, ঠিক তেমনি ফজিলত বেড়েছে সোমবার দিনেরও। হাদিস শরীফে এসেছে, আবূ কাতাদা আনসারি রা. থেকে বর্ণিত, ‘সোমবারের রোজা সম্পর্কে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, এই দিনে আমি জন্মগ্রহণ করেছি, আর এই দিনেই আমাকে রাসুল হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে (কিংবা তিনি বলেছেন) এই দিনেই আমার ওপর (প্রথম) ওহী নাজিল করা হয়েছে।’-(মুসলিম: ১১৬২, আবু দাউদ: ২৪২৬)
রবিউল আওয়াল মাসের আমল:
কোরআন হাদিসে এই মাসের জন্য আলাদা কোনো আমলের বর্ণনা পাওয়া যায় না। তাই নিজেদের পক্ষ থেকে কোনও ধরনের আমলের বর্ণনা দেওয়া শরীয়তে বাড়াবাড়ি এবং হারাম কাজ। তবে নবীজির সিরাত আলোচনা করা একটি বড় ইবাদত। এমনকি এটি ঈমানের অংশও বটে।নবীজির জন্মের ঘটনার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো তার জীবনাদর্শের অনুসরণ। জন্মের বিষয়টি একান্তই তার ব্যক্তিগত। কিন্তু তার সিরাত বা জীবনাদর্শ সব যুগের, সব মানুষের জন্য। বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য। আর নবীপ্রেমের প্রথম শর্ত হলো নবীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন না ঘটলে নবীপ্রেমের দাবি অর্থহীন।
নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জন্ম, শৈশব, নবী হিসেবে প্রেরণ, দাওয়াত, জিহাদ, ইবাদত, আখলাক-চরিত্র, নীতি-নৈতিকতা, তাকওয়া-তাহারত, দয়া-ভালোবাসা, রাগ-ক্রোধ, হাসি, উঠা-বসা, হাঁটা, ঘুম-জাগরণসহ যাবতীয় চালচলন ইত্যাদি মুসলিম উম্মাহর সামনে উপস্থাপন করা। এগুলো সামনে রেখে আলোচনা সভার অয়োজন করা, অবশ্যই ভালো এবং প্রশংসনীয় কাজ। রবিউল আওয়াল মাসে ইসলাম সমর্থন করে না এমন কাজে মেতে না ওঠে এগুলো করা যেতে পারে।
রাসূলের (সা.) জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে রয়েছে আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। এ প্রসেঙ্গে আল্লাহ তায়ালা আরো বলেন, ‘তোমাদের মধ্য থেকে যারা পরকালে আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাতের আশা রাখে ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মাঝে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ’। (আল আহযাব : ২১)।
মহামানবের এই জন্মের দিনটি স্মরনীয় করে রাখার জন্য, তার আদর্শে জীবন গড়ার জন্য মুসলিম বিশ্ব প্রতিবছর ১২ ই রাবিউল আওয়াল ঈদ-ই মিলাদুন্নবী বা সীরাতুন্নবী ইবাদাত বন্দেগির মধ্য দিয়ে পালন করে।
এছাড়াও এই মাসে খাদিজাতুল কুবরা (রা.)-এর সঙ্গে রসুলে আকরাম (সা.)-এর পরিণয় হয়েছিল ১০ রবিউল আউয়াল। মহানবী (সা.) হিজরতের উদ্দেশে রওনা করেছিলেন ১ রবিউল আউয়াল। তিনি মদিনায় পৌঁছেন ১২ রবিউল আউয়াল। প্রিয়নবী মোস্তফা (সা.) মসজিদে কুবা নির্মাণ করেন ১৬ রবিউল আউয়াল।
হাদিসের বর্ণনা অনুযায়ী ২০৬ হিজরির ৮ই রবিউল আওয়াল তারিখে ইমাম হাসান আসকারি (আ.) শাহাদত বরণ করেন এবং সেই দিনটি হচ্ছে মুসলমানদের প্রতিক্ষিত ইমাম মাহদি (আ.)এর ইমামতের প্রথম দিন। উক্ত দিনে উত্তম হচ্ছে ইমাম হাসান আসকারি (আ.)এর যিয়ারত পাঠ করা।
নবীজির জন্মের ঘটনার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হলো তার জীবনাদর্শের অনুসরণ। জন্মের বিষয়টি একান্তই তার ব্যক্তিগত। কিন্তু তার সিরাত বা জীবনাদর্শ সব যুগের, সব মানুষের জন্য। বিশ্ব মানবতার মুক্তির জন্য। আর নবীপ্রেমের প্রথম শর্ত হলো নবীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করা। বাস্তব জীবনে এর প্রতিফলন না ঘটলে নবীপ্রেমের দাবি অর্থহীন।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও পরকাল দিবস কামনা করে, তাদের জন্য আল্লাহর রাসুলের জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ।’-(সূরা আল-আহযাব: ২১)
মাহে রবিউল আউয়াল জগৎবাসীর কাছে, বিশেষত মুসলিম উম্মাহর কাছে নববী আদর্শের তথা আত্মশুদ্ধি ও সমাজ সংস্কারের পয়গাম নিয়ে আসে। এ পয়গাম বিশেষ কোনো গোষ্ঠী বা ভূখণ্ডের সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়, বরং সার্বজনীন।
নবীজী সা:-এর আগমন ঘটেছিল এমন এক সময়ে, যখন পুরো আরব জাতি হত্যা, রাহাজানি, বেহায়াপনা, বেলেল্লাপনাÑ সব কিছু মিলিয়ে আইয়ামে জাহেলিয়াত তথা অন্ধকার যুগে বসবাস করছিল। ঠিক সে সময়ে বিশ্ববাসীর মুক্তির দূত হিসেবে আগমন করেন দোজাহানের সরদার মুহাম্মদ সা:। মারামারি, হানাহানির এই পৃথিবীতে মহান আল্লাহ তায়ালা রাসূলে করিম সা:কে পাঠিয়েছেন বিশ্ববাসীর জন্য রহমতস্বরূপ। ইরশাদ হয়েছে, ‘আমি আপনাকে সারা বিশ্বের জন্য রহমতস্বরূপ প্রেরণ করেছি।’ (সূরা আম্বিয়া : ১০৭)। রাসূলুল্লাহ সা: ৪০ বছর বয়সে নবুওয়াত লাভ করেন এবং ৬৩ বছর বয়সে তিনি ইন্তেকাল করেন। মাত্র ২৩ বছরের কর্মসাধনায় তিনি সমাজ ও দেশের এমন পরিবর্তন সাধন করেন, যা মানব ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায় হিসেবে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। সমাজে মনুষ্যত্ব নির্মাণের উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি।
দীর্ঘ ২৩ বছর পর আবার এই রবিউল আউয়াল মাসেই প্রভুর সান্নিধ্যে পাড়ি জমান তিনি। রবিউল আউয়ালের কোনো একদিন রাসূল সা:-এর শরীরের উত্তাপ বেড়ে যায়। সাথে সাথে কষ্টও বৃদ্ধি পায়। একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। সামান্য স্বস্তিবোধ হলে তিনি মাথায় পট্টি বেঁধে মিম্বারে আরোহণ করেন। সমবেত সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘ইহুদি-নাসারাদের ওপর আল্লাহ তায়ালার লানত। তারা তাদের নবীদের কবরকে মসজিদে পরিণত করেছে।’ (বুখারি শরিফ)। তিনি আরো বলেন, ‘তোমরা আমার কবরকে পূজা করার উদ্দেশ্যে মূর্তিতে পরিণত করো না।’ (মুয়াত্তা ইমাম মালেক)। এরপর রাসূল সা: বলেন, ‘আমি যদি কাউকে আঘাত করে থাকি তাহলে সে আমার পিঠে চাবুক মেরে প্রতিশোধ গ্রহণ করুক।’ এই বলে তিনি নিজের পিঠ উন্মোচন করে দিলেন। তিনি আরো বলেন, ‘আমাকে এক টুকরো কাগজ এনে দাও, আমি তোমাদেরকে কিছু উপদেশ লিখে দিই। তাহলে তোমরা গোমরাহ হবে না।’ পরবর্তীকালে হজরত উমর রা:-এর অনুরোধে হুজুর সা: তা লিখলেন না। (বুখারি, মুসলিম, মিশকাত)। এ মাসের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো রাসূলুল্লাহ সা:কে ভালোবাসা। রাসূলের ভালোবাসা ঈমানের অঙ্গ। হাদিস শরিফে রাসূলুল্লাহ সা: ইরশাদ করেন, ‘তোমাদের কেউ ততক্ষণ পযন্ত পূর্ণ মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না সে আমাকে তার বাবা-মা, ছেলে-সন্তান ও সব মানুষ থেকে অধিক ভালো না বাসবে।’ (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ১১/২০০)।
কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, আমাদের মুসলিম সমাজে কিছু লোক বিশেষ করে মাজারপন্থীরা রাসূলের ভালোবাসার নামে দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার লাগিয়ে, লাল কালি দিয়ে ‘বিশ্ব আশেকে রাসূল’ লিখে দেয়াল লালে লাল করে ফেললেও রাসূলুল্লাহ সা:-এর জীবনাদর্শ ও সুন্নতকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করে না। রবিউল আউয়াল এলেই তারা ঈদে মিলাদুন্নবী, জসনে জুলুসের নামে নারী-পুরুষের সম্মিলিত বর্ণাঢ্য র্যালি, আনন্দ মিছিল ও শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে রাসূলের জন্মদিনকে শ্রেষ্ঠ ঈদ ঘোষণা করে এবং নিজেদের আশেকে রাসূল দাবি করে থাকে। বস্তুত এসব কাজ অযৌক্তিক আনুষ্ঠানিকতা মাত্র, যার কোনো শরয়ী ভিত্তি নেই। আমাদের মনে রাখতে হবে, রাসূলের ভালোবাসা শুধু রবিউল আউয়াল মাসে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়; বরং জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত প্রতিমুহূর্তে, প্রতিক্ষণে সিরাত চর্চা করা, তাঁর সুন্নতের অনুসরণ করা ও তাঁর জীবনাদর্শকে নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করা উচিত। তবেই প্রমাণিত হবে আমরা আশেকে রাসূল এবং রক্ষিত হবে রবিউল আউয়াল মাসের মর্যাদা।
E-mil: dailyalokito71sangbad@gmail.com
তথ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদনকৃত গণমাধ্যম দৈনিক আলোকিত ৭১ সংবাদ
@বিনা অনুমতিতে এই সাইটের সংবাদ, আলোক চিত্র অডিও ও ভিডিও ব্যবহার করা বে-আইনি।
Copyright © 2024 alokito71sangbad. All rights reserved.