প্রতিনিধি ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২ , ৪:২৯:৪৬ প্রিন্ট সংস্করণ
একুশ কি তা আমাদের নতুন করে জানার বিষয় না হলেও, সত্যিকার অর্থে এর মূল্যায়নটা আমরা কতটুকু দিতে পেরেছি সেটাই মূখ্য বিষয়। ভাষার মাস মানেই ফেব্রুয়ারি ২১, ১৯৫২ সালের এই দিনে এদেশের ছাত্র সমাজ আমাদের মায়ের মুখের ভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের জীবন বিলিয়ে দিয়েছিলো দুশ’রদের সামনে, ছিনিয়ে এনেছিলো মাতৃভাষা বাংলা। বাংলা ভাষা এদেশের ধনী,গরীব সকলের মুখের ভাষা তাই এ ভাষার যথাযথ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা হোক।
সভ্যতা ও সংস্কৃতির ইতিহাস থেকে জানা যায়, মাতৃভাষার গুরুত্ব যাদের কাছে যত বেশি, তারা উন্নয়নের ধারায় তত বেশি এগিয়ে। নিজেদের ভাষাকে উন্নত ও কার্যকরী করেই বিশ্বের জাতিসমূহ উন্নত ও অগ্রসর হতে পেরেছে।চীন, জাপান, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স ইত্যাদি দেশের উদাহরণ লক্ষ্য করলেই বক্তব্যটি স্পষ্ট হয়। সেসব দেশ নিজেদেরকে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমেই উন্নতির চরম শিখরে নিয়ে গেছে। তাদের ভাষাকে উন্নত করেছে। শিক্ষাকে প্রসারিত করেছে।সামগ্রিক উন্নয়ন এভাবেই সম্ভব হয়েছে প্রথমে ভাষা এবং সেই সঙ্গে শিক্ষার হাত ধরে।
শিক্ষা ও উন্নয়নে মাতৃভাষা বাংলাকে যেভাবে মূল্যায়ন করা দরকার, তা আমাদের এখানে অনেক পিছিয়ে।
ফলে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক উন্নয়ন সেভাবে পরিলক্ষিত হয়নি। এর পাশাপাশি বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে অন্যদের সাথে টিকে থাকতে হলে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ইংরেজি ও অন্যান্য বিদেশি ভাষার ব্যবহার অব্যশই মাথায় রাখতে হবে।যেহেতু সারাবিশ্বে ইংরেজি ভাষার প্রচলনই সব থেকে বেশি এবং তাদের অর্থনৈতিক অবস্থানের কারণে তারা বিশ্বকে নিয়ন্ত্রণ করে সেহেতু একটি ভালো চাকরি, কর্মসংস্থান যা-ই বলি না কেন, তা অনেকাংশে নির্ভর করে ইংরেজি ভাষায় দক্ষতার ওপর। কিন্তু মাতৃভাষার দুর্বল থেকে বিদেশি ভাষায় সবলতার আশা করা দুরাশার নামান্তর।
বরং মাতৃভাষাকে কেন্দ্রে রেখে বিভিন্ন ভাষার একটি আবহ তৈরি করাই কাম্য। যার মাধ্যমে বিশ্বের নানা দেশের জ্ঞান, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ইতিহাস, ঐতিহ্য গ্রহণ করা এবং সেসবকে নিজের দেশ ও সমাজে প্রয়োগ করাও সহজতর হবে। এইক্ষেত্রে অবশ্যই মাতৃভাষাকে সামনে রাখতে হবে। কারণ, সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক কারণে যখন কোনও জাতি তাদের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি বিসর্জন দেয় তখন তারা তাদের নিজস্ব জাতিসত্তা হারিয়ে ফেলে। নতুন কিছু শিখতে গিয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলার চেয়ে বিপদ আর কিছুতেই হতে পারে না।
ঔপনিবেশিক আমলে ইংরেজি শিখিয়ে একদল মানুষকে ইংরেজ-দাসে পরিণত করা হয়। এরা জাতিতে এদেশিয় হলেও আচরণ ও মনোভাবে ছিলেন ইংরেজ গোলাম। সেসব হয়েছিল উপনিবেশিকতার আগ্রাসনে। স্বাধীন দেশে এমন আগ্রাসন চালানোর কেউ নেই। এখন জাতিসত্তার যাবতীয় শর্ত অক্ষুণ্ন রেখেই বিভিন্ন ভাষা ও জ্ঞানের আহরণ সম্ভব। কাজটি স্বকীয়তা, নিজস্বতা ও আত্মপরিচিতি সংরক্ষণ করেই করতে হবে।সবাইকে বাংলাদেশি বানিয়েই সমন্বয়টি করা দরকার। কারণ, বাংলা যেহেতু আমাদের মায়ের ভাষা তাই শিক্ষা, বিশেষত উচ্চশিক্ষায় এ ভাষার ব্যবহার থাকলেই মানুষ নিজেকে, সমাজ ও রাষ্ট্রকে, পারিপার্শ্ব এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলকে সঠিক ও ভালোভাবে তা অনুধাবন করতে সক্ষম হবে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়াারিতে বাঙালিদের জীবন দেওয়ার মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলা ভাষার মর্যাদা। তারপর ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ। এবার নিশ্চিত মনে হয়েছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে জীবনের পর্যায়ে মাতৃভাষার দ্রুত প্রচলনের মাধ্যমে আমাদের জাতীয় মেধা ও প্রতিভার বিকাশ ত্বরান্বিত হবে। কিন্তু তেমন কিছু ঘটেনি তা অস্বীকার করার উপায় নেই। অফিস আদালতে, শিক্ষালয়ে, প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানে এখনও ইংরেজির আধিপত্য। শুধু প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালে যেমন শহীদ মিনারের ঘষামাজায় নিয়োজিত হয় কিছু শ্রমিক,
তেমনি বাংলার সর্বাত্মক প্রচলনে ব্যর্থতার দায়ভার একে অপরের ঘাড়ে চাপিয়ে উৎসারিত হয় বিলাপ। শহীদ দিবস অতিক্রান্ত হওয়ার পর যথারীতি ইংরেজিতেই প্রায় সব আনুষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক কাজকর্ম পরিচালিত হয়। শুধু তাই নয়, আমরা ভাষাশহীদদের স্মরণে যে দিবসটি পালন করি, তাও ইংরেজি মাসের নাম ও তারিখ অনুসারে ২১ ফেব্রুয়ারি। বাংলায় সে দিনটি ছিল ‘৮ ফাল্গুন’, কিন্তু আমরা তা ব্যবহার করি না এই হলো আমাদের মানসিকতা।
দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য যে, বাংলাদেশের সংবিধানে ৩নং অনুচ্ছেদে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলার কথা বলা থাকলেও বাস্তবে তার প্রয়োগ না আছে উচ্চশিক্ষায়, না উচ্চ আদালতে। ফলে বর্তমান প্রজন্ম, মুখস্থবিদ্যার ওপর অনেকটা নির্ভরশীল। বাংলাকে অগ্রাহ্য করার প্রবণতার ফলে শিক্ষাক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার পিছিয়ে গেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভাষা-বৈষম্য তৈরি করছে। যে বৈষম্য ক্রমেই সামাজিক-সাংস্কৃতিক বৈষম্য ও পার্থক্যের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলছে।ভাষা আন্দোলনের ৭০ বছর ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ৫০ বছরে এসেও আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে না পারাটা সত্যিই দুঃখের বিষয়।
মোহাম্মদ শেখ ফরিদ
এমএসএস ( রাষ্ট্র বিজ্ঞান)
সরকারি তিতুমীর কলেজ,ঢাকা।