প্রতিনিধি ১ জুলাই ২০২৪ , ৩:১৩:২৩ প্রিন্ট সংস্করণ
পাবনা জেলার সবচেয়ে বড় বিল হচ্ছে গাজনার বিল। এটি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম বিল। গাজনার বিল পাবনা জেলার সুজানগর উপজেলার অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও অন্যতম দর্শনীয় স্থান।
অবস্থানঃ
এ বিলটি সুজানগর উপজেলার মাঝখানে অবস্থিত যা পাবনা শহর থেকে প্রায় ৩৫-৩৬ কিলোমিটার দুরে অবস্থিত। সাতবাড়িয়া চিনাখড়া সড়ক বিলের মাঝখানে চলে গেছে বিখ্যাত খয়রান ব্রীজকে অতিক্রম করে।
আয়তনঃ
গাজনার বিলের আয়তন প্রায় ১২ বর্গ মাইল বা ৩১০০ হেক্টর। এ বিলে (পানি না থাকা অংশ) আবাদি জমির পরিমান প্রায় ১০ হাজার হেক্টর। বিলের পূর্ব পাশে রানীনগর ও সাগরকান্দী ইউনিয়ন, দক্ষিণে হাটখালী, ভায়না ও মানিকহাট ইউনিয়নের বোনকোলা, উলাটসহ অনেকগুলো গ্রাম স্পর্শ করেছে । উত্তর পাশে আহম্মদপুর, দুলাই ও তাঁতিবন্দ ইউনিয়নের অর্ধাংশ। পশ্চিম পাশে ভায়না ও তাঁতিবন্দ ইউনিয়নের অর্ধাংশ।
উৎসস্থল ও নামকরণঃ
সুজানগর উপজেলার আত্রাই ও পদ্মা নদীর সংযোগে সৃষ্ট এ বিল গাজনা বা বিলগন্ডহস্তী নামেও পরিচিত। বর্তমানে গাজনার বিলের পানির প্রধান উৎস এ অঞ্চলের বৃষ্টি ও যমুনা নদী পানি হলেও যুগ যুগ ধরে পদ্মা নদীর পানি গাজনার বিলে প্রবেশ করতো। জনশ্রুতি আছে বর্ষা মৌসুমে প্রমত্ত পদ্মার যে গর্জণ হতো এবং ঐ গর্জণের ফলে উত্থিত পানি দুকুল ছাপিয়ে নিম্নাঞ্চল গাজনায় এসে আটকে থাকতো। যার কারণে প্রমত্ত পদ্মার গর্জন থেকেই গাজনা বা গাজনার বিলের নাম হয়েছে।
এখানে উল্লেখ্য বিষয় যে, গাজনার বিল মূলত খয়রান ব্রীজ হতে পূর্ব দিকে তিন চার কিলোমিটার কাটাজোলা বিল পর্যন্ত গাজনার বিল নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু বর্তমানে পোড়াডাঙ্গা থেকে বাদাই জোলা পর্যন্ত গাজনা বিল নামে পরিচিত। মুজিব বাঁধ হওয়ার পর বাদাই নদী স্লুইসগেট দিয়ে যমুনার পানি গাজনার বিলে প্রবেশ করে।
বিল গাজনা-বাদাই-যমুনা খাল খনন ও তার উপর স্লুইসগেট নির্মাণ হবার পূর্বে পদ্মা নদী থেকে কয়েকটি প্রাকৃতিক ক্যানালের মাধ্যমে গাজনার বিলে পানি প্রবেশ করতো। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্যানালগুলো হলো চরসুজানগর হয়ে সুজানগর পৌরসভার কোল ঘেঁষে বান্নাই কোল হয়ে নেকের বনগ্রাম পোড়াডাঙ্গা হয়ে গাজনার বিল। নিশ্চিন্তপুর থেকে কাচুরির কোল হয়ে শাহপুর ও মঠবাড়িয়া পাশ দিয়ে মতির বিল (গাজনা বিল)। শ্যামনগর ভাটপাড়ার মধ্য দিয়ে মানিকহাটের পশ্চিম পাশ দিয়ে উলাট খয়রানের মধ্য দিয়ে গাজনার বিল।
মালিফা হয়ে ভিটবিলার পুর্ব পাশ দিয়ে বোনকোলা হাটখালীর মধ্য দিয়ে গাজনার বিল। বরকাপুর নারায়ণপুর সাগতা হয়ে গাজনার বিল। এসব ক্যানাল দিয়ে বর্ষা মৌসুমে পদ্মার পানি গাজনার বিলে প্রবেশ করতো এবং বিলের পানি জলাবদ্ধতা আকারে প্রায় সারাবছরই পানি থাকতো। সে সময় বিলের বিভিন্ন জায়গায় বড় বড় রুই, কাতলা, বাঘার, ফলি, গজার, বোয়াল, পাঙ্গাশ ইত্যাদিসহ অসংখ্য ছোট ছোট মাছ পাওয়া যেত। কোনো কোনো মাছের ওজন ২০-৩০ সের পর্যন্ত হতো। গাজনা পারের মানুষ শীত মৌসুমের শুরুতে দলবেঁধে একসঙ্গে মাছ শিকার করতো যা বাহুত নামে পরিচিত ছিল।
বিস্তৃতিঃ
১৬ টি ছোট-বড় বিলের সমন্বয়ে সৃষ্ট এই গাজনার বিল। তন্মধ্যে মতির বিল, হাতিগারার বিল, সহিবাজের বিল, ডহার বিল, রামার বিল, গমগারার বিল, পশ্চিম চক বিল ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বিলটি সুজানগর উপজেলার একেবারে মাঝখানে অবস্থিত। সুজানগর উপজেলার সবগুলো ইউনিয়ন জুড়ে এর বিস্তৃতি। গাজনার বিলে এক ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ৫০০ হেক্টর, দুই ফসলি জমির পরিমাণ প্রায় ৭৫০০ হেক্টর এবং তিন ফসলি জমি প্রায় ২০০০ হেক্টর। জলাভূমি ও পতিত জমি প্রায় নাই বললেই চলে। গভীর নলকূপ ৫টি, অগভীর নলকূপের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার এবং ৪০টির মতো শক্তিচালিত পাম্প আছে। (সূত্রঃ সুজানগর উপজেলার কৃষি সংক্রান্ত ডাটাবেজ)
অর্থের চারণভূমিঃ
বিলটি সুজানগর উপজেলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কেননা এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন অনেকাংশ এর উপর নির্ভরশীল । সুজানগর উপজেলার কমবেশি ১০ টি ইউনিয়নের সাথেই গাজনার বিল সংযুক্ত রয়েছে । বিলের চারিধারে আবাদি জমি ও সকল বসতি অবস্থিত। এই গাজনার বিলের মাধ্যমেই এই এলাকার কৃষি ও মৎস্য অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়। বিলের চারপাশে আবাদি জমির পরিমাণ প্রায় ১০ হাজার হেক্টর। এইসব জমিতে পাট, পিয়াজ ও বিভিন্ন জাতের ধান উৎপাদন হয়। বর্তমানে এই বিলের জমি বাংলাদেশের মধ্যে পেঁয়াজ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত।
দেশের চাহিদার ৩০-৪০ ভাগ পেঁয়াজ এই বিলের জমিতে উৎপাদন হয়। এছাড়া প্রচুর পরিমাণে পাট ও ধান উৎপাদিত হয়। দগত শতাব্দীর আশির দশকের শেষ দিক হতে গাজনা বিলে ইরিগ্রেশন প্রজেক্টের আওতায় ইরি বোরো ধান লাগানো শুরু হয়। এ সব কৃষি আবাদের ফলে এ অঞ্চলের মানুষের অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে তাদের জীবনযাপনে সচ্ছলতা আনয়ন করে। এছাড়া বর্ষা মৌসুমে পাবনা ও সুজানগর উপজেলার বৃষ্টির পানি ও বাদাই স্লুইসগেটের মাধ্যমে যমুনা নদী থেকে এই বিলে পানি আসে যা মৎস্য চাষের বিশাল কর্মকান্ড পরিলক্ষিত হয়। দেশীয় মাছের অভয়াশ্রম হিসেবে পরিচিত গাজনার বিলে ছোট বড় প্রায় শতাধিক প্রজাতির মাছ পাওয়া যায়। এসব মাছ এ অঞ্চলের মানুষের চাহিদা মিটিয়েও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মৎস্য আড়তে পাঠানো হয়।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যঃ
অনিন্দ্য সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর গাজনার বিলের পরিবেশ। বিলের মাঝ দিয়ে উড়ে বেড়ায় নাম জানা অজানা নানারকম পাখি। জেলেরা মাছ ধরে চলেছে ছোট ছোট নৌকা নিয়ে। কখনো বা এক ঝাঁক সাদা বক পতপত শব্দে উড়ে যায় নীল আকাশ শুভ্র সাদা করে। বিলে শাপলা পদ্ম ফুল ফোটে যা বিলকে অপরুপ সৌন্দর্য মন্ডিত করে তোলে। প্রতি বছর বর্ষার মৌসুম এলেই গাজনার বিল পানিতে থই থই করে। আর এই পানি থাকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত অবস্থান করে। তখন সভুজ শ্যামল গ্রাম বেষ্টিত বিশাল বিস্তৃত গাজনার বিল সত্যই অপরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পরিণত হয়। এক সময় রংবেরঙের পালতোলা নৌকায় বিলে মানুষ একগ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাতায়াত করতো।
দর্শনীয় স্থানঃ
বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কারণে এ সময় দূরদূরান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটক ছুটে আসেন গাজনার বিলে নৌ-ভ্রমণ করতে। বিশেষ করে শুক্র-শনি সরকারি ছুটির দিনে পর্যটকদের নৌ-ভ্রমণে সত্যই গাজনার বিল মুখরিত হয়ে উঠে। পর্যটকদের নৌ-ভ্রমণের জন্য বিলের বিখ্যাত খয়রান ব্রিজ, চরবোয়ালিয়া, গোড়ার ভিটা, শারীর ভিটা,, বস্তাল, বাদাই স্লুইসগেট এবং বোনকোলা ব্রিজ পয়েন্টে। এসব পয়েন্টে বাণিজ্যিকভাবে রাখা হয়েছে ইঞ্জিন চালিত বড় নৌকা ও ডিঙি নৌকা। তাছাড়া, পর্যটকদের দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে মাঝে-মধ্যে বিলের খয়রান ব্রিজ পয়েন্টে রাখা হয় বিশাল বাইচ-এর নৌকা। পর্যটকরা এসব বাইচ’র নৌকায়ও বিল ভ্রমণ করে থাকেন। তবে বাইচ’র নৌকায় সাধারণত স্থানীয় পর্যটকরা ভ্রমণ করেন। পর্যটকরা সকাল থেকে সূর্যাস্তের আগ পর্যন্ত বিলের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত নৌ-ভ্রমণ করেন।
বিল গাজনার নামে প্রতিষ্ঠানঃ
১৯৭২ সালে রানীনগর গ্রামে একটি উচ্চবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যার নামকরণ করা হয় রানীনগর বিলগাজনা উচ্চ বিদ্যালয়। যা বর্তমানে মহাবিদ্যালয় হয়ে রানীনগর বিল গাজনা স্কুল এন্ড কলেজ নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠাতা হবিবর রহমান।
বর্তমানে শুকনো মৌসুমে গাজনার বিলের মাঠে প্রবেশের জন্য বিভিন্ন গ্রাম হতে জলডোবা পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে কৃষকেরা জমির ধান পেঁয়াজ ও অন্যান্য ফসলে সহজে ঘরে তুলতে পারে। সুজানগর উপজেলার কৃষি অর্থনীতির প্রাণভোমরা গাজনার বিল বা বিল গন্ডহস্তী।