প্রতিনিধি ১৩ জানুয়ারি ২০২২ , ৩:৩০:০৭ প্রিন্ট সংস্করণ
দেশে করোনার নতুন ধরন ওমিক্রন রোধে সরকারিভাবে দেওয়া ১১ দফা বিধিনিষেধ আজ থেকে কার্যকর হচ্ছে। পরবর্তী সিদ্ধান্ত না আসা পর্যন্ত সবাইকে এসব বিধিনিষেধ বাধ্যতামূলকভাবে মানতে হবে।এর ব্যত্যয় হলেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, করোনা রোধে এটি সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। তবে বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে সমন্বিতভাবে কাজ না করলে ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে।
বিশেষজ্ঞারা জানান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে দেশে চলতি বছরের প্রথম দিন থেকেই সংক্রমণ ক্রমাগত বাড়ছে। গত এক সপ্তাহে রোগী শনাক্তের হার বেড়েছে ১৬৯ শতাংশ। যেখানে ডিসেম্বরে মাত্র ৪ হাজার ৫৮৮ জন নতুন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। সেখানে চলতি মাসের ১১ দিনে এ সংখ্যা ১২ হাজার ৮৫০ জনে পৌঁছেছে। ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যবিভাগ কয়েকটি জেলাকে সংক্রমণের উচ্চঝুঁকি, মধ্যম ঝুঁকি ও কম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করেছে।
বুধবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (অসংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন জানান, সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ঢাকা ও রাঙ্গামাটি জেলাকে সংক্রমণের রেড জোন অর্থাৎ উচ্চঝুঁকির তালিকায় রাখা হয়েছে। হলুদ জোন বা মধ্যম ঝুঁকির তালিকায় রয়েছে ৬ জেলা। বাকি ৫৪টি জেলা কম ঝুঁকি অর্থাৎ সবুজ জোনে রয়েছে।
তিনি বলেন, দেশে গত এক সপ্তাহে শনাক্তের হার দ্বিগুণ হয়েছে। ৫ জানুয়ারি শনাক্তের হার ছিল ৪ দশমিক ২০ শতাংশ। সেখানে ১১ জানুয়ারি তা বেড়ে ৮ দশমিক ৯৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। অথচ বর্তমান পরিস্থিতিতে উপসর্গ দেখা দেওয়ার পর করোনা পরীক্ষা করা জরুরি হলেও অনেকেই তা করাচ্ছেন না। পরীক্ষার সংখ্যা বেশি হলে রোগীর সংখ্যা ও সংক্রমণের হার আরও অনেক বেশি হতো।
সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১ জানুয়ারি পর্যন্ত করোনা নিয়ন্ত্রণে ছিল। এরপর থেকে সংক্রমণের হার ক্রমাগত বাড়ছে। কোনো নির্দিষ্ট ধারায় তা বৃদ্ধি পাচ্ছে না, যা খুবই আতঙ্কের বিষয়। গত এক সপ্তাহে করোনা পরীক্ষা ১০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থাৎ এ সময়ে দেড় লাখেরও বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। শনাক্তের হিসাবে পূর্ববর্তী সপ্তাহের চেয়ে ৬ হাজারেরও বেশি (১৬৯ শতাংশ) রোগী শনাক্ত হয়েছে।
এদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সতর্ক বার্তা দিয়ে স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনের জন্য বলা হচ্ছে। ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ফের ১১ দফা বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অতীতে সাধারণ মানুষ লকডাউন কিংবা বিধিনিষেধের প্রতি উদাসীন মনোভাব দেখিয়েছে। কারণ এর সঙ্গে মানুষের জীবন-জীবিকার বিষয় জড়িত।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সংক্রমণ উদ্বেগজনকভাবে বাড়তে থাকায় গণপরিবহণে মোট আসনের বিপরীতে অর্ধেক যাত্রী নিয়ে চলতে হবে। এতে ভাড়া বাড়বে। এরই মধ্যে ভাড়া এক ধাপ বেড়েছে। কিন্তু গত দুই বছর ধরে চলা মহামারিতে অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। এছাড়া সড়ক পরিবহণ খাতে প্রায় ৭০ লাখ শ্রমিক রয়েছেন। যাদের প্রায় ৮০ শতাংশই দুই ডোজ টিকার আওতায় আসেনি। তাদের মাধ্যমে যাত্রীরা সংক্রমণ ঝুঁকিতে থাকবে। এছাড়া সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিধিনিষেধ আওতার বাইরে রয়েছে। বলা হচ্ছে ১২ বছরের বেশি বয়সি স্কুল শিক্ষার্র্থীদের টিকা সনদ নিয়ে বিদ্যালয়ে যেতে হবে। কিন্তু এখনো উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী টিকার বাইরে রয়েছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরালোজি বিভাগের একজন চিকিৎসক যুগান্তরকে বলেন, ১০ ডিসেম্বর দেশে প্রথম ওমিক্রন শনাক্ত হয়। কিন্তু ধরনটির জিন বিশ্লেষণ কম হচ্ছে। ৫০০ জন শনাক্ত রোগীর মধ্যে মাত্র ১ জনের নমুনার জিন বিশ্লেষণ হয়েছে। এত কম সংখ্যক নমুনা বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোন ধরন কি পরিমাণে ছড়াচ্ছে, তা বলা মুশকিল হচ্ছে। ফলে সংক্রমণের এ বৃদ্ধি করোনার অতি সংক্রামক ধরনের কারণে, নাকি অন্য কারণেও হচ্ছে- তা এখনো স্পষ্টভাবে জানা যাচ্ছে না।
বিশিষ্ট চিকিৎসা বিজ্ঞানী অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, কোনো পদক্ষেপ যদি বাস্তবায়নযোগ্য না হয়, তার প্রতি জনগণের আস্থা থাকে না। কারণ কোনো কিছু মানতে বলা হলে বিকল্প সুবিধা করে দিতে হবে।তিনি বলেন, উন্মুক্ত স্থানে সব ধরনের সামাজিক রাজনৈতিক, সভা সমাবেশ, জনসমাগম বন্ধ থাকবে বলা হচ্ছে। কিন্তু এখনো আন্তর্জাতিক ব্যাণিজ্য মেলা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন ও সিটি করপোরেশন নির্বাচনে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে গণসংযোগ চলছে।
তিনি আরও বলেন, প্রজ্ঞাপনে বাজার-ঘাট ও অফিস-আদালতে মাস্ক না পরলে আইনি ব্যবস্থার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে ব্যত্যয় রোধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার কথা বলা হয়েছে। রেস্তোরাঁয় খাবার গ্রহণ এবং আবাসিক হোটেলে থাকার জন্য অবশ্যই টিকার সনদ দেখাতে বলা হয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন ও মাস্ক পরার বিষয়ে মসজিদে মসজিদে জুমার নামাজের খুতবায় ইমামরা মুসল্লিদের সচেতন করবেন। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের এ বিষয়টি নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে। এভাবে ১১ নির্দেশনার সবই পরিবেশ ও জীবন-জীবিকার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সমন্বিত কার্যক্রম পরিচালন এবং এতে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে করোনা নিয়ন্ত্রণ চ্যালেঞ্জে পড়বে।
স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. এমএ আজিজ বলেন, করোনা সংক্রমণ বেড়েছে। এই ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে ১১ দফা বিধিনিষেধ দেওয়া হয়েছে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যেসব মন্ত্রণালয় রয়েছে তাদের কাজ করতে হবে। পাশাপাশি এর সঙ্গে জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।