প্রতিনিধি ৩১ অক্টোবর ২০২২ , ১১:১০:১৬ প্রিন্ট সংস্করণ
বই মানুষকে আলোকিত করে সুন্দর জীবনের পথ দেখায়। অতীতের সাথে বর্তমানের সেতুবন্ধন হচ্ছে বই।প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে বহুজ্ঞানী-জন ইলমের যে বাগান সাজিয়েছেন তার পুষ্পসৌরভে মোদিত হওয়ার একমাত্র মাধ্যম হলো বই । কোনো কোনো বই মানুষের মনোজগতকে উজ্জীবিত করে। চেতনাকে শাণিত করে। মানবিকতা জাগিয়ে তোলে। কখনো একটি বই হতে পারে জীবন পরিবর্তনের কারণ। বইকে বলা যায় মানুষের শ্রেষ্ঠ সঙ্গী। বই অধ্যয়নের প্রশংসা করতে গিয়ে একজন মনীষী বলেন, “বই আপনার সর্বোত্তম বন্ধু। বই আপনাকে আলোর পথ দেখাবে। জীবন পথের পাথেয় যোগাবে। বইয়ের সান্নিধ্য আপনাকে অসীম দিগন্তে নিয়ে যাবে এবং অজানা রহস্য মেলে ধরবে। বই মানুষের আত্মার খোরাক। তাই ফেইসবুকের লাইক কমেন্সের নেশা ছেড়ে; এমনকি আরামপ্রিয় ও অলসদের সঙ্গ ছেড়ে বইয়ের সঙ্গ গ্রহণ করুন।”
বইয়ের ভালোবাসা যখন কারো হৃদয়ে স্থান করে নেয় তখন অন্য সব ভালোবাসা ম্লান হয়ে যায়। আমাদের আকাবির জ্ঞানীদের হৃদয়ে ঠিক এমন ভালোবাসা ছিল বইয়ের প্রতি অকল্পনীয় মুতালাআ বই মুতালাআ করে অনেকেই। ছোট ছোট বই পেলে একটু আগ্রহ করে পড়ে, কিন্তু বই কিছুটা দীর্ঘ হলেই আগ্রহের জোয়ারে ভাটা পড়ে। আর যদি তা হয় কয়েক খণ্ডের তবে তো হিম্মত আরো কমে যায়। তবে পৃথিবীর ইতিহাসে অমর ব্যক্তিত্ব মুহাম্মাদ ইবনে আলী ইবনু দাকীকিল ঈদ রাহ. (মৃত্যু : ৭০২ হি.) হতে পারেন এক্ষেত্রে আমাদের প্রেরণার উৎস।
তিনি ছিলেন জ্ঞানের সমুদ্র। তবে তা এমনিই হয়ে যায়নি; বরং রাত-দিনের একনিষ্ঠ অধ্যয়ন তাঁকে পৌঁছে দিয়েছে ইলমের সর্বোচ্চ শিখরে। যেখানে খুব কম মানুষই পৌঁছাতে পারে।
আদফুবী রাহ. বলেন, তার মুতালাআর ক্ষমতা ছিল অকল্পনীয়। আমি আলমাদরাসাতুন নাজীবিয়্যাহ-এর লাইব্রেরি ঘুরেছি। সেখানে অনেক গ্রন্থ ছিল। ইবনুল কাসসারের ‘উয়ূনুল আদিল্লাহ’ও ছিল সেখানে। ত্রিশ খণ্ডের এই বিশাল কিতাবের পাতায় পাতায় দেখেছি তার (ইবনু দাকীকিল ঈদ) কলমের দাগ। আলমাদরাসাতুস সাবেকীয়্যাহতেও যাওয়া হয়েছিল আমার। বাইহাকী রাহ.-এর ‘আসসুনানুল কুবরা’ ছিল সেখানে। এই বিশাল গ্রন্থের প্রতিটি খণ্ডেই আমি তার কলমের দাগ দেখেছি। তাছাড়া তারীখে বাগদাদ, মুজামুত তবারানী আলকাবীর, আলবাসীত লিল ওয়াহিদীতেও দেখেছি তার কলমের দাগ। (আততালিউস সায়ীদ, পৃষ্ঠা ৫৮০)
প্রিয় পাঠক! একটু চিন্তা করুন। এ গ্রন্থগুলো সম্পর্কে যাদের সামান্য জানাশোনা আছে তারা জানেন একেকটি গ্রন্থের কলেবর কত বৃহৎ। আদ্যোপান্ত অধ্যয়ন তো দূরের কথা শুধু পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পুরো কিতাবের ঘ্রাণ নিয়েছেন এমন মানুষ এ যুগে খুব কম পাওয়া যাবে, কিন্তু এ মহান মনীষী এ পুরো কিতাব অধ্যয়নের সাথে সাথে পাতায় পাতায় এঁকে গেছেন মুতালাআর চিহ্ন।
সিরাজুদ্দীন রাহ. বলেন, আল্লামা রাফেয়ী রাহ.-এর ‘আশশারহুল কাবীর’ যখন প্রকাশিত হয় তিনি তা এক হাজার দিরহাম দিয়ে ক্রয় করেন। এরপর তিনি শুধু নামায পড়া ছাড়া বাকি সময় কিতাব মুতালাআয় নিমগ্ন থাকতেন। এভাবেই শেষ করেন পুরো কিতাব কিংবা গ্রন্থ। (প্রাগুক্ত) ইবনু দাকীকিল ঈদ রাহ.-এর বেশির ভাগ সময় অর্থকষ্ট লেগেই থাকত। সম্পদের প্রাচুর্য তার ছিল না। তাই ঋণ করেই অনেকসময় বই ক্রয় করতেন।
বই সংগ্রহের নেশাঃ
মানুষের সখের শেষ নেই। একেকজনের সখ একেক রকম। কারো সখ ঘুরে বেড়ানো। আবার কারো বই পড়া। আবু মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ ইবনে আহমাদ ইবনুল খাশশাব আননাহবী রাহ. (মৃত্যু : ৫৬৭)-এর শখটি ছিল বই সংগ্রহ করা। সাথে অবিরাম মুতালাআ তো আছেই। ইবনুন নাজ্জার বলেন, কোনো আহলে ইলম মারা গেলেই ইবনুল খাশশাব রাহ. তার সকল কিতাব কিনে ফেলতেন। এভাবে মাশায়েখদের অনেক কিতাব জমা হয়েছিল তার কাছে। তার হাতে সবসময় কিতাব থাকত। আর তিনি নিবিষ্ট চিত্তে অক্লান্তভাবে সারাদিন মুতালাআয় ডুবে থাকতেন। (সাফাহাত মিন সাবরিল উলামা, পৃষ্ঠা ৩২১)
ইবনুল আখদার রাহ. বলেন, আমি একদিন উসতাদজীর কাছে যাই। তিনি তখন অসুস্থ ছিলেন। তবুও বুকে বই রেখে মুতালাআ করছিলেন। আমি বললাম, এ কী? তিনি বললেন, ইবনে জিন্নী নাহুর একটা মাসআলা বলে শে‘রের একটি পংক্তি দিয়ে তা প্রমাণ করতে চেয়েছেন। তবে ব্যপারটা খুব ভালোভাবে স্পষ্ট করতে পারেননি। অথচ এ মাসআলার সমর্থনে আমার সত্তরটি পংক্তি জানা আছে। (শাযারাতুয যাহাব ৬/৩৬৬)
বাড়ি বিক্রি করে বই সংগ্রহ:
বই সংগ্রহের জন্য কি কেউ তার বাড়ি বিক্রি করতে পারে? আপাতদৃষ্টিতে তা অসম্ভব। তবে এক বইপ্রেমী বইয়ের প্রতি ভালোবাসায় এ অসম্ভবকে বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন।ইবনুল খাশশাব রাহ. একবার গ্রন্থের বাজারে গেলেন। তখন একটা বই খুব পছন্দ হলো তার। তবে দামটা একটু বেশি। পাঁচশত দিনার। অত টাকা তার সংগ্রহে ছিল না তখন। তবুও তিনি বইটি কিনে ফেললেন। বিক্রেতার কাছে দাম পরিশোধের জন্য তিন দিন সময় নিয়ে বাড়িতে চলে গেলেন। গিয়েই ঘটালেন এক অবাক কাণ্ড। বাড়ি বিক্রির জন্য ডাক উঠালেন। একজন পাঁচশত দিনার বলতেই নগদ টাকা নিয়ে বাড়ি বিক্রি করে দিলেন। এরপর সে টাকা দিয়ে পরিশোধ করলেন বইয়ের মূল্য! (সাফাহাত মিন সাবরিল উলামা, পৃষ্ঠা ৩২১-৩২২)
প্রিয় পাঠক! আপনি কি ভেবেছেন ইসলামী ইতিহাসে এমন ঘটনা একটাই ঘটেছে? না, বরং এর নযীর আরো আছে। বইয়ের প্রতি এই প্রেম ও হৃদয়ের টানের কারণেই তো সে যুগে আমরা ছিলাম পৃথিবীর সর্বোন্নত সভ্যতার ধারক-বাহক।
আবুল আলা হাসান ইবনে আহমাদ বিন সাহল আলআত্তার রাহ. (মৃত্যু : ৫৬৯ হি.)। তিনি ছিলেন ধনী পরিবারের সন্তান। বাবা ব্যবসা করতেন। তাই বাবার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারসূত্রে অঢেল সম্পদ লাভ করেছিলেন। তবে এগুলো দ্বারা তিনি বিলাসিতা করেননি। পুরোটাই ইলম অর্জনের জন্য ব্যয় করেছিলেন। একদিনের ঘটনা। বাগদাদে ইবনুল জাওয়ালিকী রাহ.-এর কিতাব কিংবা বইসমূহ বিক্রি হচ্ছিলো।
আবুল আলা রাহ.-ও সেখানে গেলেন। কিছু কিতাবের তখন দাম হাঁকা হল ষাট দিনার। তিনি তা কিনে ফেললেন। তবে দাম পরিশোধের জন্য সময় চাইলেন এক সপ্তাহ। সাথে সাথে রওয়ানা দিলেন মাতৃভূমি হামাযানের দিকে। বাড়ি পৌঁছে বাড়ি বিক্রির ঘোষণা দিলেন। একজন ষাট দিনারের কথা বললো। তিনি রাজি হয়ে গেলেন। আশপাশের লোকজন বললো, এ বাড়ির দাম তো আরো বেশি হবে। তিনি বললেন, না, এ দামেই বিক্রি করবো। তখন ষাট দিনারেই বাড়ি বিক্রি করে দেয়া হলো। অর্থ নিয়ে তিনি আবার ছুটলেন বাগদাদের দিকে। বাগদাদ থেকে হামাযান। আবার হামাযান থেকে বাগদাদ আসা-যাওয়ার মাঝেই কেটে গেল এক সপ্তাহ। এসে তিনি বইয়ের দাম শোধ করে দিলেন। (সাফাহাত মিন সাবরিল উলামা, পৃ. ৩২৩)
৫৬৯ হিজরীতে এই মহান মনীষী ইন্তেকাল করেন। একজন স্বপ্নে দেখলেন, তিনি একটি শহরে, যার সবগুলো দেয়াল তৈরি করা হয়েছে বই কিংবা কিতাব দিয়ে। আবুল আলা রাহ.-এর চারপাশেও অসংখ্য বই। তিনি গভীর নিমগ্নতায় সেগুলো মুতালাআ করছেন। স্বপ্নেই তাকে জিজ্ঞেস করা হল, এর রহস্য কী? তিনি বললেন, আমি আল্লাহর কাছে আরজি জানিয়েছি, দুনিয়াতে আমি যা নিয়ে ব্যস্ত থাকতাম এখানে তা নিয়েই ব্যস্ত থাকার সুযোগ তিনি যেন আমায় করে দেন। আল্লাহ তাআলা আমার এ চাওয়া কবুল করেছেন। (প্রাগুক্ত)
হে আল্লাহ! কিতাবের প্রতি এমন ভালোবাসা, এমন পাঠনিমগ্নতা আমাদেরকেও নসীব করুন- আমীন।
ঈদের দিনেও পাঠনিমগ্নতা ঈদের দিন কী করি আমরা? খাওয়া-দাওয়া, ঘুরা-ফেরা এই তো! কিন্তু বই পড়া, কিতাব মুতালাআর চিন্তা কি করি কখনো? না। মূসা বিন মুহাম্মাদ রাহ. একসময়ের জ্ঞানরাজ্য আন্দালুসের বিখ্যাত মনীষী। তার ছেলে আবুল হাসান রাহ. বাবার সম্পর্কে বলেন, বাবা ৬৭ বছর জীবিত ছিলেন। তবে বই পড়া ও লেখালেখি ছাড়া একটা দিনও তিনি অতিবাহিত করেননি। এমনকি ঈদের দিনও এ ধারা অব্যাহত থাকত। একবার ঈদের দিন আমি তার কামরায় যাই। তিনি তখন লিখছিলেন। আমি বললাম, বাবা! আজ ঈদের দিনও আপনি বিশ্রাম করবেন না? তিনি তখন চোখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। মনে হলো যেন আমার উপর রাগ করেছেন। বললেন, আমার মনে হয় তুমি জীবনে সফল হতে পারবে না। তুমি কি এ ভিন্ন অন্য কিছুর মাঝে আনন্দ খুঁজে পাও? খোদার কসম এর চেয়ে অধিক আনন্দের কাজ আমার জানা নেই। (নাফহুত তীব মিন গুছনিল আন্দালুস আররাতীব ২/৩৩৪) আহ! আমরাও যদি বই পড়ায়এমন আনন্দ খুঁজে পেতাম। লেখালেখি ও অধ্যয়নের মাঝে এমন প্রশান্তি যদি আমাদেরও অনুভব হত। তাদের মত কিংবা তার কিছু অংশ।
বদ্ধ ঘরে তিন বছর! সানাদ ইবনে আলী বলেন, আমার বাবা খলীফার রাজদরবারে কাজ করতেন। খলীফাও তাকে অনেক ভালোবাসতেন। উকলিদাসের পাঠ শেষ করে আমি মিজাসতী বই পড়া শুরু করতে চাইছিলাম। তবে বইটি ছিল না আমার কাছে। বাগদাদে তখন এক লিপিকার এ বইটি বিশ দিনারে বিক্রি করতো। আমি বাবাকে বললাম তা কিনে দেয়ার জন্য। বাবাও কিনে দেয়ার আশ্বাস দিলেন। কিন্তু দিব দিচ্ছি করে করে অনেক দিন হয়ে গেলেও আর কিনে দিলেন না। আমার এক ভাই ছিল। আমার মত পড়াশোনার এত আগ্রহ তার ছিল না। বাবার সাথে বিভিন্ন কাজ করতো। একদিনের ঘটনা। বাবা কোনো একটা কাজে গিয়েছিলেন এক জায়গায়। আমিও সাথে গেলাম সেদিন। বাবা ভেতরে কাজ সারার সময়টাতে বাহন জন্তুকে ধরে রাখাই ছিল আমার কাজ। বয়স আমার তখন মাত্র সতেরো বছর।
বাবা ভিতরে যাওয়ার পর এক ছেলে এসে আমাকে বলল, তোমার বাবা অনেক সময় এখানে অবস্থান করবেন। তাই তুমি চলে যাও। আমি তখন বাহনজন্তুটা নিয়ে সোজা বাজারে চলে গেলাম। বাবাকে না জানিয়েই তা তিরিশ দিনারের কিছু কমে বিক্রি করে দিলাম। এরপর বিশ দিনার দিয়ে মিজাসতী বইটা কিনে বাড়ি ফিরে এলাম। মাকে এসে বললাম, আজ খুব বড় একটা অপরাধ করেছি। এরপর পুরো ঘটনা শুনিয়ে মাকে কসম দিয়ে বললাম। বাবা যদি এ কারণে আমার উপর রাগ করেন তবে তোমাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাবো আমি। একথা বলে অতিরিক্ত মূল্যটা মাকে ফেরত দিয়ে দিলাম। বাড়িতে আমার একটা ঘর ছিল। সেখানে একাকী থাকতাম আমি। মাকে বললাম, ঘরে ঢুকে আমি দরজাটা লাগিয়ে দেবো। বইটি পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি আর বের হবো না। তোমার কাছে অনুরোধ, প্রতিদিন একটা মাত্র রুটি বাহির থেকে আমার ঘরে নিক্ষেপ করবে। কয়েদিকে যেমন খাবার দেয়া হয় সেভাবে।
মা আমাকে বাবার দিকটি দেখার ব্যাপারে আশ্বস্ত করলেন। আমি এরপরই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। এদিকে আমার ভাই বাবার কাছে গিয়ে সব বলে দিল। শুনতেই বাবার মুখের রং বদলে গেল। উপস্থিত অন্যদের চোখ থেকে ব্যাপারটা এড়ালো না। জিজ্ঞেস করলো, ব্যাপার কী? একটা খবর শুনেই আপনি এমন বদলে গেলেন কেন? বলুন তো কী হয়েছে? বাবা আমার ঘটনা বললেন, অন্যরা বলল, বাহ্! আপনি তো অনেক ভালো একটি সন্তান লাভ করেছেন। এমন ছেলে ক’জনের ভাগ্যে জোটে। আপনি আপনার ছেলেকে কিছুই বলবেন না। আর এই নিন আগেরটার চেয়ে অনেক সুন্দর একটা বাহন আপনাকে দিচ্ছি।
সানাদ ইবনে আলী বলেন, আমি সেই ঘরে তিনটা বছর এক দিনের মত কাটিয়ে দিলাম! (আলমুকাফাআহ্ পৃ. ১১৯; সাফাহাত মিন সাবরিল উলামা, পৃ. ২৭৫-২৭৭)
আহমাদ ইবনে মুহাম্মাদ আসসিলাফী রাহ. (মৃত্যু : ৫৭৬ হি.)-এর পাঠনিমগ্নতা
আবদুল কাদের রুহাবী বলেন, সিলাফী রাহ. ইসকান্দারিয়া থাকা অবস্থায় একদিন শুধু ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। তিনি সবসময় মাদরাসাতেই থাকতেন। আমরা যখনই তার কাছে যেতাম দেখতাম তিনি মুতালাআয় নিমগ্ন।
আওকী রাহ. বলেন, সিলাফী রাহ. আমাকে বলেছেন, আমার এখন ষাট বছর, অথচ এ দীর্ঘ সময়ে আমি একবারের জন্যও ইসকান্দারিয়ার প্রসিদ্ধ মিনার দেখতে যাইনি। (অথচ এটা ছিল পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্যের একটি) হাঁ, মাদরাসার জানালা দিয়ে যতটুকু দেখা যায় এতটুকুই।
হাফেয আবদুল আযীম মুনযিরী রাহ. বলেন, সিলাফী রাহ.-এর কিতাব সংগ্রহের প্রচণ্ড আগ্রহ ছিল। যা অর্থ আসত কিতাব কিনেই খরচ করে ফেলতেন। (সাফাহাত মিন সাবরিল উলামা, পৃ. ৯৩)
বইপ্রেমী তিন মুসলিম মনীষী
আবু হাফফান রাহ. বলেন, তিন ব্যক্তির মত বইপ্রেমী আমি আর কাউকে দেখিনি। জাহেয, আলফাত্হ ইবনে খাকান, ইসমাঈল বিন ইসহাক আলকাযী।
এক. জাহেয (মৃত্যু : ২৫৫ হি.)
জাহেয এতটাই বইপ্রেমী ছিলেন যে, কোনো বই পেলেই তিনি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে ফেলতেন। বইটা যে বিষয়েরই হোক না কেন। অনেকসময় বই বিক্রেতাদের দোকান ভাড়া নিয়ে রাত জেগে বই পড়তেন।
দুই. আলফাত্হ ইবনে খাকান (মৃত্যু : ২৪৭ হি.)
সবসময় ইবনে খাকানের হাতে কোনো না কোনো বই থাকত। প্রাকৃতিক প্রয়োজন পূরণ কিংবা নামাযের জন্য বই পড়ার মজলিস থেকে উঠে যাওয়ার প্রয়োজন হলে হাঁটতে হাঁটতেই বই পড়তেন। মসজিদ কিংবা হাম্মামে যাওয়ার আগ পর্যন্ত চলত অধ্যয়নের এ ধারাবাহিকতা। প্রয়োজন শেষে মজলিসে ফিরে আসা পর্যন্ত আবার শুরু হত অধ্যয়ন। মুতাওয়াক্কিল কোনো প্রয়োজনে উঠে গেলে ফেরার আগ পর্যন্ত আবার কিতাব মুতালাআ শুরু করতেন।
প্রথমে ইচ্ছা ছিল খুব বেশি দিন মিশরে থাকবো না। তবে সেখানে ইলমের যেই আসর দেখেছি, জ্ঞান-প্রদীপদের যেভাবে আলো ছড়াতে দেখেছি তখন এই আলো বুকে ধারণ না করে আর যেতে মন চাইল না। প্রথমে ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর কিতাবসমূহ শোনার ইচ্ছা আমার ছিল না। কিন্তু পরে ইলমের এ ঝর্ণা থেকেও ইলম শুধা পান করার আগ্রহ জেগে উঠল। ইমাম শাফেয়ী রাহ.-এর কিতাব সম্পর্কে ভালো জানা-শোনা আছে- প্রথমে এমন একজনকে খুঁজে বের করলাম। তার সাথে কথা হল, দিরহামের বিনিময়ে সবগুলো কিতাব সে আমাকে অনুলিপি করে দেবে। তখন কাগজের প্রয়োজন দেখা দিলো। কিন্তু কাগজ ছিল না আমার কাছে। মিশর থেকে দুই জোড়া কাপড় আমি কিনেছিলাম। ইচ্ছে ছিল বাড়ি গিয়ে তা সেলাই করে পড়ব।
কিন্তু কাগজের কোনো ব্যবস্থা না হওয়ায় উপায়ান্তর না দেখে কাপড় জোড়া বিক্রি করে দেয়া হল। এরপর বিক্রিত মূল্যের কিছু অংশ দিয়ে কাগজ কেনা হল। (সাফাহাত মিন সাবরিল উলামা, পৃ. ২৬১-২৬২) বইয়ের প্রতি এ ভালবাসার জন্য তারাও এক একজন হয়ে উঠেছিলেন জীবন্ত কিতাব। তাদেরকে দেখেও অনুভব করা যেত কিতাবের সৌরভ। সে সৌরভ সুরভিত করত আলেম-তালিবুল ইলম সকলকে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবার মনেই কিতাবের প্রতি এমন ভালবাসা দান করুন- আমীন।
কবি ও লেখক:
শিহাব আহম্মেদ
সভাপতি-ধ্রুবতারা সাহিত্য একাডেমি
সম্পাদক-আলোকিত ৭১ সংবাদ