প্রতিনিধি ২৬ মার্চ ২০২২ , ৮:২৯:২৩ প্রিন্ট সংস্করণ
উৎসর্গের মাঝে
লেখায়-তাশফিয়া আদ্রিতা
মা ছেলে কে নিয়ে বড্ড সচেতন, গরীব ঘরে হলেও ছেলেকে আদর্শ মন মানসিকতায় দেখতে চান! বাবা এগুলো নিয়ে বেশি ভাবেন না ২বেলা ২ মুঠো ভাত জোটালেই উনি যেন মস্ত খুশি!
কারণ বাবা যে দিন মজুর। দিন আনে দিন খায়! কখনো এমন ও দিন গেছে বাবার পেটে পানি ছাড়া কিছু পড়েনি কিন্তু শানু ও তার মাতা কে না খায়িয়ে রাখেন নি! এটাই পিতৃ স্নেহ! পৃথিবীর সব বাবা এভাবেই নিজের সার্থ বলি দিয়ে পরিবার কে বাঁচিয়ে রাখে।শানু ছোট বেলা থেকেই খুব চঞ্চল ও দেশ প্রেমিক!একদম ছোট বেলায় সে তার মায়ের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনেছে।
শুনেছে লক্ষ্য লক্ষ্য শহীদের উৎসর্গ! তার পর থেকেই সে সবাইকে বলে বেড়াই আমিও তবে উৎসর্গ করব নিজেকে বাংলার জন্য!।বয়স তার বেশি না ১০ হবে আগামী সপ্তাহে ২৬ শে মার্চ, সুতরাং স্বাধীনতার দিবসে!ছেলের উৎসর্গের কথা শুনে মা সূচনা দত্তের বড্ড বুক কেঁপে উঠে! শানু এজন্য বেশ কয়েকবার মার ও খেয়েছে!হাজার হোক মা তো মা ই! ছেলেকে তার অসীম ভালোবাসা স্নেহ দিয়ে আগলে তো রাখবেই!আসলে পৃথিবীতে সবাই তার নিজ নিজ অবস্থান হতে দায়িত্বশীল!
শানুর মাতা সূচনা দেবী তার জায়গা থেকে পরিবার সামলাচ্ছেন!অপরদিকে শানুর বাবা অজয় বাবু দু বেলা দু মুঠো এনে দিয়ে নিজেকে উৎসর্গ করে সবাইকে আগলে রাখছেন,আর শানু নিজেকে উৎসর্গ করতে চায় দেশের জন্য!ছোট বেলা থেকেই তার মধ্যে দেশ প্রেম বিরল!যদিও বিদ্যালয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য আদেও হয়নি তার বাবা দিনমজুর তবুও মাতা সূচনা দেবীর অনুরোধে বাবা বলেছিলো আগামী বছর নিজের কিডনি বিক্রি করে হলেও শানুকে বিদ্যালয়ে পাঠাবেন!শানু সব সময় একটাই ভাষণ দিত সবাইকে,
” এবারের সংগ্রাম,মুক্তির সংগ্রাম”।অর্থাৎ আমাদের জাতির পিতার সেই ঐতিহাসিক ভাষণ!
আসলে শানু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সব কিছু অনুকরণ করার চেষ্টা করত!
সে তার বন্ধু বান্ধব পাড়া প্রতিবেশী থেকে সকল কেই একই কথা বলত,
“যখন জন্মেছি এই বাংলায়,মৃত্যু হয়েও অমর হব এই বাংলার মাটিতেই”সত্যিই এত ছোট একটি প্রাণ পরিপূর্ণ বোঝার বয়স হওয়ার আগেই সে দেশের প্রতি তার এমন উক্তি এমনভাবে ভালেবাসা প্রকাশ করবে!এমন পাওয়া আসলেই দুষ্কর!
শানু,মুক্তিযুদ্ধের গল্প পড়ত লুকিয়ে লুকিয়ে!
বাবার তো বই কিনে দেয়ার সামর্থ্য ছিল না!
একটা ছেলে প্রায় ই আসত তার কিছু বই শানুদের কুড়ে ঘরের একটু সামনের দোকানে রেখে যেত!
শানু সেখান থেকে বই গুলে পড়ত!
শানু ছিল বড্ড বুদ্ধিমান, দোকানি কেও ছলে বলে কৌশলে পটিয়ে নিয়েছিল, তাই যখন ছেলেটি বই দিয়ে চলে যেত শানু গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়ে ফেলত! হয়ত ঐ ছেলেটিও ছিল কোন বই প্রেমিক! বই কেন রেখে যেত সেটা জানা যায়নি!আর মাত্র দু’দিন বাকি ২৬ শে মার্চ এলো তবে!শানুর উন্মাদনার শেষ নেই,তার জন্মদিন ও বটে!
আবার সবতেকে বড় কথা স্বাধীনতা দিবস!
শানুর বেশি উন্মাদনা ছিল স্বাধীনতা দিবস নিয়ে,তার জন্মদিন নিয়ে সে এত টা বেশি মাথা ঘামায়নি!শানু ঠিক করেই ফেলেছে সেদিন সে ভীড়ের মাঝে যাবে সকলের যাবে,এ যেন তার বায়না!তাদের বাড়ীর থেকেই একটু দূরে আছে মাঠ সেখানে বিভিন্ন গান এবং ভাষণের মাধ্যমে উৎযাপিত হয় স্বাধীনতা দিবস।সবাই ফুল আর পতাকা নিয়ে যায়!তবে ফুল হয়ত শানু জোগাড় করে ফেলবে কিন্তু পতাকা টা তার খুব দরকার!।
বাংলাদেশের পতাকা শানুর খুব প্রিয়!
সবুজের মাঝে রক্তিম বৃত্ত!সত্যিই মনোমুগ্ধকর আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণ করিয়ে দেয়।এবার তো শানু বায়না ধরেছে তার পতাকা লাগবেই লাগবে!মা তাকে মেরেছেও তবুও সে যে থামেনা!
মা তো লুকিয়ে লুকিয়ে কাঁদে একটা পতাকা কিনে দাওয়ার সামর্থ্য ও যে নেই! গেল আরো একদিন!
২৫ শে মার্চের দিন শানু ভীষন মা কে বলছে বার বার “মা ১০ টা টাকা দাওনা গো”!যেখানেই দু বেলা দু মুঠো খাওয়া টাই নিশ্চিত হয় না সেখানে পতাকা কিনে দাওয়া তাদের কাছে বিলাসিতার বিষয়!
শানু ভীষণ কান্না শুরু করল!রাত্রে কাঁদতে কাঁদতে ঘুৃৃমিয়ে গেছে!মা ও যে কাঁদছে, অতঃপর সূচনা দেবীর খেয়াল এল একটি সবুজ শাড়ী তার আছে যদিও পুরনো হয়ে গেছে, সেখান থেকে সূচনা দেবী চতুর্ভুজ আকৃতিতে কেটে নিল, ওনার প্রশ্ন জাগল রক্তিম লাল বৃত্ত টি কিভাবে আকবে অতঃপর তিনি,
নিজের হাতে আঘাত করে, রক্ত ঝড়িয়ে তাহা দিয়েই বৃত্ত অংকন করলেন!সূচনা দেবী বানিয়ে ফেললেন পতাকা! সূচনা দেবী এবার মহা খুশি ছেলেকে তিনি পতাকা বানিয়ে দিতে পেরেছেন।
সকাল হলো শানু ঘুম থেকে উঠল,
মা ছেলের কাছে গিয়ে পতাকা দিয়ে বললেন” যা বাবা তুই যা “।আর কিছু বললেন না! শানু তো ভীষন খুশি! নদীতে গোসল করেই সে একদম প্রস্তুত যাওয়ার জন্য!মা তার হাতটি লুকিয়ে রেখেছেন যেন ছেলে আঘাতের চিন্হ না দেখতে পায়!
অতঃপর ছেলে চলে গেল!
ছেলে যাচ্ছে তার বন্ধুদের নিয়ে হঠাৎ কিসের ভীড়ে যেন আটকে গেল! হয়ত স্বাধীনতা উপলক্ষেই কোন রথযাত্রার মতই ছিল সেটা! সবাই উল্লাসিত বিজয় দিবসে। সবার দৃষ্টি তখন বাতাসে উড়ন্ত পতাকাগুলির দিকে।এই ভীরের মাঝে যে ছোট্টো একটি হাতও পতাকা উড়িয়েছে তা কারো দৃষ্টিগোচর হোলনা।কার যেন ধাক্কায় মাটিতে পড়ে গেল শানু।উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ হলো না,কেও তাকে তুললোওনা।শানুর দমবন্ধ হয়ে আসছে।শেষ মুহূর্তে শানুর মুখে একটি হাসি ফুটে উঠে।তার বলা কথাটিই সত্যি হলো। “মৃত্যু হয়েও অমর হব এই বাংলার মাটিতেই”।
সাথে থাকা বন্ধুরা ভীড় দেখে সাহস করে আর এগোয়নি!
অপর দিকে মা সূচনা দেবী পাশের বাসা থেকে দুধ,চিনি ধার করে নিয়ে এসে পায়েস রান্না করে রেখেছে ছেলের জন্মদিন বলে কথা!
সন্ধ্যা হয়ে যায়, ছেলে এখনো ফেরেনি সূচনা দেবী তো কেঁদে কেঁদে অস্থির। অবশেষে একটি খবর এলো।সুচনা দেবী একটি চিৎকার দিয়ে সেইযে চুপ হলেন আজ এতবছর পরেও আর কোনো কথা বলেনি সে।
আইনি ঝামেলা এড়াতে কোনো এক সরকারি লোক আড়ালে রেখেছিল শানুর মৃত্যুসংবাদ।
স্বাধীনতা দিবসে উৎসর্গের মাঝে এই উৎসর্গটি ধরার কেও জানেনি, স্বর্গে থাকা শহীদরা জেনেছেন কি?